গল্প | লাল চিঠি

লাল চিঠি

গ্রামটির নাম রজবপুর। কি নেই এ গ্রামে? সবই আছে। গ্রামের একপাশে বয়ে চলে নদী, যার দুপাশেই ঘন ঘন জঙ্গল । দূরে গিয়ে মেশা ক্ষেতের বাহার। যেখানে সর্ষে আর ধানের আবাদ হয় সারাবছর ধরে। শিশুরা হইচই করে পুরো গ্রামকে মাতিয়ে রাখে। এই শিশুদেরকেই দেখা যায় বিকেলে গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে দৌড়াদৌড়ি করতে, দুপুরে নদীতে স্বভাবসুলভ হইচই মাচাতে। গ্রামের সৌন্দর্যের কাছে হার মেনে যায় সবাই, যে বা যারাই এখানে বেড়াতে আসে। কথিত আছে বহু বছর আগে, এক যোদ্ধা ঘায়েল হয়ে ছুটতে ছুটতে এই এলাকায় এসে, হঠাৎ এইখানে থামে। তখন এইখানে কেউ থাকতো না। যোদ্ধা জঙ্গল থেকে লতাপাতার রস লাগিয়ে নিজের ক্ষতের চিকিৎসা করেছে। এরপর এখানেই থাকা শুরু করে, একদিন নদীর পাশ দিয়ে কিছু রমণী যাচ্ছিলো, তাদের মধ্যে একজনকে তার পছন্দ হয়। এরপর তাকে বিয়ে করে, সংসার পাতে এইখানেই। এরপর কয়েক যুগ পর পরিণত হয় গ্রামে। নানান নাম শেষে, এখন এই গ্রামের নাম রজবপুর।  
এ গ্রামে খুব ভোরে ডেকে উঠে কিছু অচিন পাখি। পাখিদের গান শুনে জেগে উঠত গ্রামের মায়াবতী মেয়ে রুপা। তার সুরেলা কণ্ঠে সকাল সকাল বেজে উঠে কিছু মোহনীয় গানের সুর। যে শোনে সেই বলে, আহা!স্বর্গীয়। কে এই কোকিলা? যে ই প্রথম তার  সুরেলা কণ্ঠে গান শোনে সে ই মেয়েটির নাম মনে মনে আন্দাজ করে নেয়, কোকিলা!
সে রূপবতী, সে গায়িকা। সে বাবা মায়ের আদরের দুলালী। তার মুখে সবসময়ই হাসি থাকত। তাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি। তাকে কেউ রাগতে দেখে নি। সে শুধু অভিমান করত, সে শুধু আবদার করত, ভালোবাসার আবদার। সে রুপা, আমাদেরই রুপা। গ্রামের মধ্যমণি রুপা।  
রুপা বেশ হাসিখুশি মেয়ে, পৃথিবীর সবচেয়ে হাসিখুশি মেয়ের জীবনেও একসময় এলো আঁধার! ঘোর লাগা আঁধার। সে আঁধারে অনেক আলোও হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় রুপার মত মেয়েদের হাসিখুশি চেহারা। তাদের গান হারিয়ে যায়। রুপারও এমন হলো। বাতাসে এসে জ্বলন্ত আগুনকে যেভাবে দপ করে নিভিয়ে দেয় সেভাবে রুপার হাসিও উড়ে চলে গেল দূরে, আর ফিরে আসেনি।  
সেদিন বিকেলে রুপা চিরচেনা নদীর পাশের জঙ্গলে একা একা আনমনে ঘুরছিলো। গুনগুনিয়ে গান গাইছিল, তার ধ্যান জ্ঞানে ছেদ ঘটল তার বান্ধবীর বিস্ফোরিত কণ্ঠ শুনে। তার বান্ধবী রীতার চোখে পানি ছিল। দৌড়ে এসেই রুপাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে শুরু করে দিলো। রুপা কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না। জিজ্ঞেস করলো, “কি হল? কাঁদছিস কেন?” রীতার কান্নার গতি তাতে কমেনি, বেড়েই যায়। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে লাগল, “রাসেল ভাই আর নেই রে রুপা।”
“কি?” ঝাঁকুনি দিয়ে রীতাকে বলল, “কি আবোল তাবোল বকছিস তুই?”
রীতা কিছু বলেনি। কান্নার গতি যেমন ছিল তেমনই রইল। সীমার চোখ দেখে রুপার বুঝতে বাকি রইল না যে রীতা মিথ্যে কিছু বলেনি। কোমলমতি রুপার গাল বেয়ে পানি ঝরতে শুরু করে। অনেক উপর থেকে ধুপ করে কোন ভারী বস্তা পড়ার মত করে রুপা পড়ে গেল মাটিতে।
রাসেল রীতার বড় ভাই। যে কিনা রুপার হবু স্বামী ছিল। তাদের মাঝে আরো একটি সম্পর্ক ছিল, ভালোবাসার সম্পর্ক। অনেক ভালোবাসতো একজন আরেকজনকে। রাসেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিল, তার পড়াশোনা শেষ হলেই আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের বিয়ে। কিন্তু তাদের নিয়তে হানা দেয় কিছু দানব। ২৫ শে মার্চ কালরাত্রের হত্যার শিকার হয় রাসেল। ঢাকায় রাসেলের দেহের মৃত্যু ঘটে আর এদিকে তার পরিবারের এবং তার প্রিয় মানুষগুলোর মনের মৃত্যু ঘটে। তাদের মনে  পাকবাহিনীর জন্য জ্বলে উঠে ঘৃণার আগুণ।
ঐদিন পুরো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল রুপা। কারও সাথে কোন কথা বলে নি। নীরবে কাঁদছিল সে। যখন খাটিয়া করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল রাসেলকে তখন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রুপা আর স্মৃতির পাতা আউড়িয়ে শুধু চোখের পানি ঝরিয়েছিল। রাসেল তাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সে নিজেও অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে দিল না কিছু ধাতব বুলেট। পায়ে, পেটে আর বুকে মিলে মোট চারটা বুলেটে বিদ্ধ হয়েছিল রাসেল।  

দু
চিঠিটা নেড়ে চেড়ে উল্টেপাল্টে দেখল আবার সে। বানান আর শব্দচয়ন ঠিক আছে কিনা বার বার খতিয়ে দেখতে আরও কয়েকবার পড়ল। এতটাই সতর্ক যেন চিঠিটায় ভুল হলেই তার হাজতবাস নিশ্চিত।  কিন্তু ‘ও’ তো আর মানবেনা, একটু ভুল দেখলেই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এই নিয়ে বলবে, “বাহ রে বাহ, জগত খ্যাত যে বিশ্ববিদ্যালয় তারই ছাত্র হয়ে তুমি করলে বানানে ভুল? নাহ বাপু না, আমি এইটা মানতে পারছিনা।”
শেষবারের মত পড়া শেষ করেই আপনমনে বলল, নাহ! সব ঠিকঠাক।   
এবার সে আস্তে আস্তে করে রুমমেট এর ট্রাঙ্ক এরদিকে এগিয়ে গেল। খাটের দক্ষিণ পাশে পড়ার টেবিলের সাথে লাগোয়া ওটা। পড়ার টেবিলটাও একটু গাবদা সাইজের। তাই ওটার নাগাল পেতে একটু বেগ পোহাতে হল। ট্রাঙ্কে টর্চের আলো ফেলতেই দেখতে পেল তালা লাগানো। ওটা খুলতে হলে এখন চাবির প্রয়োজন পড়বে কিন্তু চাবি কোথায় পাবে সে?
মনে পড়লো, ট্যাঙ্কের চাবি বালিশের নিচে রাখে তার বন্ধু শাহেদ।  
ভাবছে বালিশের মাঝ বরাবর নিচে থাকলে কিভাবে নিবে? টেনশন হচ্ছে তার! উঠে বালিশের পাশে যেতেই মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো রাসেলের। চাবিটা মাঝ বরাবর নয়, বরং কাছাকাছিতেই আছে। চাবিটা সরিয়ে নিতে বেশি সময় নিলো না সে। এরপর ট্রাঙ্কটা এমন ভাবে বের করলো যেন শব্দ না হয়! এরপর তালাটা খুলে ভেতরের কয়েকটা দুর্লভ বই আর কাপড় সরাতে লাগলো! নাহ! ওটা নেই। শিট! কোথায় গেল পারফিউমটা? সেই নির্দিষ্ট খোপেও দেখল ভালোকরে। নাহ, ওটা নেই।
তার মনে পড়ে গতবার বাড়ি যাওয়ার সময়, শাহেদও বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখনই ট্রাঙ্ক খুলে নির্দিষ্ট একটা খোপ থেকে বের করে স্বচ্ছ কাচের বোতলটা। যার ঘ্রাণে মুহূর্তেই পুরো কামরা মোহিত হয়ে পড়ে। এরপর না চাইতেই শাহেদ বলে, “নে লাগিয়ে নে একবার দেখ ভালো লাগবে।”
রাসেল বাড়িতে যাওয়ার আগেই কাঁচা রাস্তাটায় দেখা হয়ে যায় রুপার সঙ্গে। রুপা গ্রামের ইশকুলে পড়ায়, সেখান থেকে ফিরছিল। রাসেলকে দেখেই রুপা বিগলিত এক হাসি দিয়েছিল। তারা তখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিল, তখন রুপা বিস্ময়ে বলেছিল, “কি সুন্দর ঘ্রাণ!”
আজ চিঠি লেখার সময় এই কথাটা মনে পড়তেই ভাবল, চিঠিটার উপরে কিছুটা এই জাদুকরী সুগন্ধি মাখিয়ে দিবে।
এমন সময় ঘরের আলো জ্বলে উঠল। চমকে উঠে রাসেল। পেছনে ভারী কণ্ঠে শাহেদ বলে, “জনাব এইটাই কি চাচ্ছিলেন?” আবার মুখ বাঁকিয়ে বলে, “এভাবে না হাতিয়ে বললেও পারতেন”
লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে রাসেল। এমন সময় জিপ থামার শব্দ শুনে তারা। দুইজনই বিস্মিত! এত রাতে তাদের এদিকে জিপ! কি ব্যাপার!

তি 
“স্যার, কাহাসে শুরু কারু?” হিন্দি আর উর্দুর মিশ্রণে ক্যাপ্টেন আফতাব শেরজিল কে জিজ্ঞেস করেছিলো স্থানীয় ধুরুন্দর লোক, খালেক মিয়া।
“উস ঘার সে।” তারা পৌঁছানোর সাথে সাথেই যে ঘরে আলো জ্বলে উঠে সেটার দিকে ইঙ্গিত করলো ক্যাপ্টেন। ঘরটা হলো রাসেল আর শাহেদের। নিচতলায় হওয়ায় ওদিকে আগে যাওয়া সুবিধার হবে বলেও ভাবছে ক্যাপ্টেন। তাছাড়া ওদিক থেকেই করিডোরের শুরু।
“আচ্ছা সাব” খালেক মিয়া বিগলিত হাসি দিলো। আর সাথে সাথে তার লাল রঙা ঠোঁট আর দাঁত বুঝিয়ে দিলো বিরাট পান-খোর খালেক মিয়া।
সেদিকে দ্রুত পা চালাল পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনী। তারা আজ এই মধ্যরাতে এমনি এমনি আসেনি। রক্তের নেশা আজ তাদেরকে পেয়ে বসেছে।    

চা
“দরওয়াজা খোলো, দরওয়াজা খোলো!” চিৎকার করে দরজায় কড়া নাড়তে থাকে হানাদাররা।
রাসেল আর শাহেদ বুঝে গেছে দরজার বাইরে কারা। শাহেদ জানালার কাছে গিয়ে জানালার লোহা বাঁকানো যায় কিনা দেখছে। এমন সময় দরজা ভেঙে ডুকে পড়ে তারা।
দরজার সামনে হানাদারদের দেখে রাসেলের মুখ শুকিয়ে যায়। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, “আপনারা?”
দরজা ভাঙ্গার শব্দ আরো শোনা যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে তারা সংখ্যায় কম আসেনি। হলের মানুষজন জেগে উঠেছে। আলো জ্বলে উঠছে। ছোটাছোটি করা শুরু হয়ে গেছে। একটা গুলির শব্দ কানে এলো। রাসেলের তখন পরিবারের সবার কথা চোখে ভাসতে লাগলো। রুপার হাসিমাখা মুখ মনে পড়তেই চোখ ভিজে উঠে।
রাইফেল একটা উঁচু হয়ে উঠল। জানালার কাছে থাকা শাহেদ ধুপ করে পড়ে গেল। রাসেল একবার শুধু সেদিকে তাকালো। তীব্র শব্দে সব কিছু ভোঁতা লাগছে। চোখে পানি জমায় ঝাপসা দেখছে সে, ঝাপসা দৃষ্টিতেই দেখতে পেল তার দিকে রাইফেলের নল ঘুরে আসছে। রাসেল তার টেবিলের দিকে হঠাৎ যাওয়া শুরু করে। তখনই গর্জে উঠে রাইফেল। পায়ে বিদ্ধ হয় প্রথম গুলিটা। পড়ে যায়, চিঠিটা টেবিলে রাখতে গিয়ে পারলো না। এরপর হানাদারদের দিকে ফিরলে পেটে আর বুকে বিদ্ধ হয় আরো  কয়েকটা গুলি। একটা হাতে শক্ত করে চিঠিটা ধরে রেখেছিলো, হাতটা নিজ থেকে একটু দূরে দূরে রাখলো সে। যাতে রক্ত না লাগতে পারে। বরং, ওটাতে রক্তের ছিটে লেগে জায়গায় জায়গায় লাল হয়ে গেছে। চিঠিটাতে রক্ত লাগা ঠেকাতে পারেনি রাসেল।  

পাঁ
২৫ মার্চ, ২০১৬

বৃদ্ধাশ্রমটাকে একটা বাগানবাড়ির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। একটা মাত্র টিনশেড ঘর। তাও সেটা ট্রেনের মত লম্বা। একবার বাঁক নিলো, হয়ে গেল ইংরেজি ক্যাপিটাল এল আকৃতি। মানুষ বেড়ে যাওয়ায় আরও দু একটি ঘর বাড়ালে সেটি হয়ে যায়, ইংরেজি ভি এর আকৃতি। এই বাড়িটাকে ঘিরেই চারপাশে অসংখ্য বৃক্ষ।
এই বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালিকার মায়ের মৃত্যু কিছুদিন আগে হয়ে গেছিলো। মা তাকে এই বৃদ্ধাশ্রম আর একটা চিঠি দিয়েছিলেন, মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে। বার বার একটা কথা বলেছিলেন তিনি। এগুলোর যেন কোন ক্ষতি না হয়। এগুলো যেন পরম যত্নে সে সামলে রাখে। পরিচালিকা রেহানা এমনটিই মাকে আশ্বাস দেয়।
সে জানে এই চিঠিটার মূল্যমান তার মায়ের কাছে কতটুকু। সে এখন তার মায়েরই কবরের সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে বৃদ্ধাশ্রমেরই একটা গাছের নিচে কবর দেয়া হয়েছে। তার ইচ্ছাতেই।
রাসেলের মৃত্যুর অনেকদিন পর পর্যন্ত রুপা রাসেলের মৃত্যুর শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বলতে গেলে মানতেই পারেনি সে। রজবপুর গ্রামটা ছিল নদীর পাশে জঙ্গলে ঘেরা এক অঞ্চল। এখানে হানাদাররা আসতে আসতে সেপ্টেম্বর পেরিয়ে যায়। গ্রামের পরিবেশ ততদিন ছিল নিরুত্তাপ। শুধু যতটুকু রেডিওতে শুনেছিলো, তাতেই গ্রামের মানুষ জানতো, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হানাদাররা আসা খবর পেয়েই পালিয়ে যায় রুপারা কলকাতায়, রুপা যুদ্ধে অংশ নিতে চেয়েছিলো; বাবার অনুরোধে পারেনি। তাদেরকে নিয়ে  চলে যায় পার্শ্ববর্তী দেশে। নিজ দেশে ফিরে, ‘৭৩ এ বিয়ে করে বাবার পছন্দ মত ছেলেকে।  
কাঁচের ফ্রেমে বন্দি কিছু একটা বের করলো রেহানা। আজ ২৫ শে মার্চ, আজ যে তার মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের ভালোবাসার মানুষের রক্ত রঞ্জিত চিঠিটা পড়তে হবে। চিঠিটা পড়তে শুরু করলো সে। আধা পৃষ্ঠা পড়তেই তার চোখে পানি চলে আসে। সে পানি রক্তের মত ভিজাতে পারেনি চিঠিটাকে। চির অক্ষত রাখার জন্যই হয়ত তার মা এটাতে কাঁচের ফ্রেমে বন্দি করে রেখেছিলেন।    

                                               (সমাপ্ত)


গল্পটি লেখা হয়ঃ ১৭/১২/১৬ তারিখে। প্রকাশ হয়, এইখানে


PDF/EBOOK আকারে পড়তে চাইলে, ডাউনলোড করে নিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ