গল্প | দিপা












বস্তির পূর্বদিকে ছোট্ট একটা ঘরে ভোরের প্রথম আলোটা হুট করে বাদশাহি বেশে ডুকে শ্যামলা রঙের মেয়েটিকে আলিঙ্গন করে, তাকে সোনালী করে তোলে নিজের মত করে। মেয়েটি নিজের সকল দুঃস্বপ্ন ঝেড়ে এক ঝটকায় উঠে বসে, মলিন হয়ে যাওয়া কাপড়ের আঁচলে ঘেমে যাওয়া কপাল মুচে। পালঙের পাশে রাখা মাটির কলসি থেকে পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে  সে। মেয়েটির নাম দিপা।
দিপার ঘুম আসে না। শুয়ে থাকে তারপরও। দিপাকে তার বুড়ি মা তেমন কোন কাজ করতে দিত না, নিজের মত করে সারাদিন ঘরে কাটিয়ে দিতেই সে পারদর্শী, তবে বুড়ি মায়ের অজান্তে কারো কারো বাড়ি ঝি এর কাজ করেছে। তার বুড়ি মা সারাদিন নিজের ঝোলায় করে বাদাম বুট বেচত; আর ভিক্ষা করত মাঝে মাঝে। এভাবেই তাদের চলে যেত দুবেলা দুমুঠো খেয়ে। গেল পাঁচ দিন ধরে বুড়ির কোন খোঁজ মিলছে না। বুড়ির জন্য খারাপ লাগে তার। বুড়িই তাকে তার শেষ সময়ে আশ্রয় দিয়েছিল, সবসময় বাঁচিয়েছে বস্তিবাসীর কু নজর থেকে। দালাল করিম থেকে বাঁচানোর জন্য কত লড়াই ই না করেছিল বুড়ি।
বুড়ির একটা মাত্র মেয়ে ছিল, জন্মের পর পরই তারে বুড়ি নিজের অজান্তেই ডেকে ফেলেছিল, রুপা। দিপার মতই মায়া কাড়া চোখের অধিকারিণী ছিল সে। একদিন হারিয়ে যায় বড় শহর ঢাকাতে। মেয়েকে খুঁজতেই বুড়ির বাদাম বুটের ব্যবসা শুরু করা। প্রতি অলি গলিতে খুঁজেছে কিন্তু রুপাকে পায়নি, একদিন ঝড়ের রাতে পেয়েছিল পোয়াতি দিপাকে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল রাস্তায়।
দরজায় টোকা পড়ল তখনই, দরজা খুলে দিলে দেখে পাপ্পু এসেছে, তাকে নিতে। পাপ্পু এই বস্তিতেই থাকে। বুড়ির জানাশোনা। কখনও কোন ভেজালে জড়াতে দেখেনি পাপ্পুকে। সেই পাপ্পু তাকে বলেছে, তার বুড়ি মাকে খুঁজে দিবে। সারা ঢাকা শহর নাকি তার নখদর্পণে। পাপ্পুর সাথে কম কথা হলেও দিপা পাপ্পুর চোখে তার জন্য সম্মান দেখেছে। যার কারণে দিপা তার কথায় বিশ্বাস করতে পারে অনায়াসে।  
দিপা আসো জলদি
আসছি, একটু
পাপ্পু সামনে সামনে হাঁটছে। আর দিপা পেছন পেছন। ভাবছে আজও ঐ ছেলেটা আসবে তো? বুড়ি মায়ের হারিয়ে যাওয়ার দিন সারাদিন এখানে ওখানে খুঁজেছে দিপা আর পাপ্পু, কোথাও খুঁজে পায়নি। সারাদিন কিছু খায়ও নি সেদিন।পরদিন পাপ্পু তাকে একটা কন্সট্রাকশন সাইটে কাজ যোগাড় করে দেয়, এই পাঁচদিন সে ওখানে কাজ করছে। দিনে ২০০ টাকা করে পায় সে। কখনও সেখানে ইট ভাঙ্গে আবার কখন মাথায় করে ইট বালু কিংবা মশলা আনা নেয়ার কাজ করে। বাইরে এইসব কাজ করতে দিপার ভালো লাগছিল না প্রথম দুই দিন ধরে, ভাবছিল ছেড়ে দিবে। কিন্তু তৃতীয় দিন বদলে যায় তার মনোভাব। তৃতীয় দিন সে যখন মাথায় ঢালা ভর্তি মশলা নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কোত্থেকে যেন একটি তিন চার বছরের বাচ্চা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে মা বলে। মা ডাকটি শুনতেই দিপা আঁতকে উঠেছিল, ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কেঁদে দিয়েছিল প্রায়। নিজের কোমরে  অন্য হাতটা মুছে ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল বার কয়েকবার।  ছেলেটার দিকে তাকিয়ে তার কান্না পাচ্ছিল, তার মেয়ে অনামিকা বড় হলে নিশ্চয়ই এমন হত। মাথার চুল তখনও বড় হয়নি, চোখ গুলো বড় বড়, মিষ্টি একটা ছোট মুখ। তাকিয়ে থাকত আর বার বার তাকে বিরক্ত করত নানা কারণে। বলত, মা এটা লাগবে, মা ওটা লাগবে। তখনই একটা দারোয়ান গোছের লোক এসে, ‘স্যরিবলল আর নিয়ে গেল রাস্তার ওপাশটায় একটা বাড়িতে। অনুজ্জ্বল একটা সাইনবোর্ড বলে দিচ্ছে মা-বাবা যাদের বহুদূরে চলে গেছে তাদের বাস ওখানে। অনেকক্ষণ সে ওভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল, ছেলেটাকে জোর করে যখন নিয়ে যাচ্ছিল, বারবার বলছিল সে, আমি মায়ের কাছে যাবো, আমি মায়ের কাছে যাবো।
এরপরের দুই দিন ঐ দারোয়ান গোছের লোকটা কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে আসত ছেলেটাকে।ওখানের বড় আপার নির্দেশেই।বড় আপা আসছিলেন ওর সাথে দেখা করার জন্য, উনি নিজ চোখে দেখেছিলেন শাওন ছেলেটা দিপার কাছাকাছি এসে কত খুশি হয়ে যেত।তাই উনিও আর না করেননি।
গায়ে স্পর্শ পেতেই চমকে উঠল দিপা। স্মৃতির আবছা আলো আঁধারি থেকে ফিরে আসলো সে।
কি ভাবছ?” পাপ্পু জিজ্ঞেস করলো।
কিছুনা”, দিপা উত্তর দেয় আনমনে।
তারা ততক্ষণে কনট্রাকশন সাইটে চলে এসেছে। পাপ্পু চলে যাওয়ার সময় দিপা ডাকে, “পাপ্পু    মাকে খুঁজে বের করতে আর কতদিন লাগবে?”
যেতে বলে, “তোমার মাকে খুঁজে দেব চিন্তা করো না!পাপ্পু চলে গেলে কাজে মন দেয় দিপা, আগের চেয়েও দ্রুত এবং সাবলীল গতিতে কাজ করে সে, কারণ সে চায় না শাওন ছেলেটা যখন আসবে তখন তার কাজ যেন এর মাঝে না আসে। কিছুক্ষণ ঐ ছেলেটার জন্যই বরাদ্দ থাকুক।
আজকেও কাজের ফাঁকে শাওনকে নিয়ে আসে দারোয়ান সলিমুদ্দিন। শাওন এসে দিপাকে আগের মতই জড়িয়ে ধরে ফেলে।দিপা কাজ থেকে আধা ঘণ্টার জন্য ছুটি নেয়। ছেলেটার সাথে খেলবে কিছুক্ষণ সে। সে যখন ছেলেটাকে নিয়ে খেলছে এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামে অনাথ আশ্রমের গেইটের সামনে। গাড়িটা দেখেই ভয় পেয়ে যায় সলিমুদ্দিন। সে শাওন কে নিয়ে চলে যায় দ্রুত। দিপা চেয়ে থাকে অপলক। কিছুই বুঝে নি, কি ঘটল। আজকে ছেলেটা এত কম সময় থাকল তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
ওদিকে গাড়িতে বসে ছিলেন শহরের অন্যতম প্রতাপশালী ব্যক্তি জোবায়ের হাওলাদার।তিনি ঢাকা সিটির দুইজন মেয়রের একজন।গাড়িতে বসে সব দেখছিলেন মেয়র।নিজের রাগের উপর কোন দখল নেই লোকটার। এখন ইচ্ছে করছে পুরো আশ্রমটার কিছু একটা করতে।কিন্তু না বসে রইলেন উনি। ড্রাইভার গেইট পেরিয়ে ডুকে গেল আশ্রমের প্রাঙ্গণে।আজ উনি এর একটা রফাদফা করবেন, সরাসরি অনাথ আশ্রমের প্রধানের রুমে যাবেন, তার কাছে এর একটা ব্যাখ্যা চাইবেন।
দারোয়ান সলিমুদ্দিন মা বাবা হারা এই সন্তানদের দেখে মন খুব খারাপ হয়, তাদের জন্য কিছু যদি করতে পারে ঐদিনটা তার ভালো যায়। শাওন অনেক কান্না করছিল ঐদিন মহিলা টার কাছে যাওয়ার জন্য। সলিমুদ্দিন বুঝতে পারে বাচ্চাটা নিজের মা মনে করেছে ঐ মেয়েটাকে। আশ্রমের কাউকে কিছু না বলেই কয়েকদিন দেখা করাতে নিয়ে যায় সে।শুধু বড় আপা জানত ব্যাপারটা, বলতে গেলে উনিই সলিমুদ্দিনকে বলে রেখেছিলেন, বড় আপা হলেন, আশ্রম প্রধানের স্ত্রী।কিন্তু আজ উনি নেই, বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। আজকে শাওনের চাচা দেখে ফেলেছে, আজকে আর রক্ষা নেই তার। লোকটা দিনের আলোতেই অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখে।
আশ্রম প্রধানের রুমে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কথা শুনছে আশ্রম প্রধানের,তার পাশে পিচ্ছি শাওন দাঁড়িয়ে ছিল।শাওন একজন সিস্টার এসে ভেতরে নিয়ে যায়।সলিমুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করা হল, সে এই কাজে লজ্জিত কিনা? সলিমুদ্দিন বলল, না আমি লজ্জিত না, এতটুকু একটা ছেলেকে যদি আমি তার মায়ের ভালোবাসা একটুকুও দিতে পারি ঐ দিনমজুরের মাধ্যমে আমি ধন্য, খোদার দেশে শাওনের মাও হয়ত খুশি হয়েছেন।
মেয়র জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল অন্য দিকে।কথাগুলা শুনে তাকাল সলিমুদ্দিনের দিকে।মেয়রের চোখের দিকে তাকিয়ে করণীয় বুঝে নিয়ে আশ্রম প্রধান তখন দারোয়ান সলিমুদ্দিনকে বললেন, ‘আগামীকাল থেকে তোমার আর কাজে আসা লাগবে না। কথাটা শোনার সাথে সাথে দুচোখে অন্ধকার দেখতে পেল সে।
গেইট দিয়ে দুজন ব্যক্তি একসাথে বের হল, দারোয়ান সলিমুদ্দিন একটু আগে যা করলো তা নিয়ে ভাবছে। তার চাকরিটা অনেক জরুরী ছিল, তারপরেও হুট করে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে জানে না। কেবল এইটা জানে, তার এখন একটা কাজ দরকার যে করেই হোক। তার মন বলছে সে ভুল কিছু করেনি আর বড় আপা আজ থাকলে তার চাকরিটা যেত না। ভাবছে বড় আপার সাথে দেখা করবে সলিমুদ্দিন।
আরেকদিকে মেয়র এগিয়ে গেলেন, কন্সট্রাকশন সাইট টার দিকে। ওখানে গিয়ে দিপাকে কয়েকটা কথা যা শোনালেন দিপা মুখে আঁচল রেখে সব শুনল। আঁচলে তার সবটুকু অশ্রুজল আড়াল করার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ এরপর দৌড়ে চলে গেল যখন কথাগুলো তার কান সহ্য করতে পারছিল না।
বাসায় ফিরে ভাঙ্গাচোরা পালঙে শুয়ে অনেক কাঁদল দিপা। তার মনে পড়তে শুরু করে তার অনামিকা কে হারানোর দিন গুলো। তার মনে পড়তে শুরু করে বুড়ি মায়ের কথা। শাওনকে নিজের ছেলে ভেবে আদর করার মুহূর্ত গুলো।
অনেক বছর আগে ছোট্ট সবুজ শ্যামল গাঁয়ে দিপা করত ছোটাছুটি, যেন ছিল অবাধ্য ঘাসফড়িঙ। গাঁয়ের দুরন্তপনায় মেতে থাকা দিপার বিয়ে হয় অল্প বয়সেই। শহুরে ছেলে মাসুমের চাকরি যখন চলে যায় দিপাকে বলতে থাকে বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে ব্যবসার ব্যবস্থা করে দিতে। দিপা বার বার গ্রামে এসে ফিরে যায়। বাবার সামর্থ্য ছিল না সেই টাকা জোগাড় করে দিতে। এইসব চলার সময়ে একদিন দিপা বুঝতে পারে সে মা হতে চলেছে। ঐ সময়েই মাসুম কোথাও যেন কাজ পেয়ে যায়। নতুন মানুষটা আসাকে নিয়ে চলতে থাকে নানা আয়োজন। শেষ মুহূর্তে মাসুমের মাথায় ভূত ডুকে তার প্রথম সন্তান হলে ছেলেই হবে। কিন্তু ডাক্তার বলে অন্য খবর, দিপার গর্ভে মেয়ে সন্তান।
৬ মাস চলছিল তখন মাসুম একটা চেকাপ এর কথা বলে নিয়ে তাকে একটা ক্লিনিকে। কেউ কেউ নীল পলিথিন হাতে বের হচ্ছিল, দেখে অবাক হয় কিঞ্চিত। অপেক্ষা করতে করতে একটা পলিথিন এর দিকে চোখ যায় তার, ছোট একটা রক্তাক্ত পা বেরিয়ে- একটি কুকুর দৌড়ে যাচ্ছে সেদিকে। পলিথিন হাতে থাকা লোকটির খেয়াল ছিল না, পথিলিন থেকে ছোট্ট মানব দেহটাকে এক ঝটকায় বের করে নিয়ে আসে কুকুরটা। দিপা তখন বুঝে যায় ওর অনামিকাকে মারতে চায় মাসুম। ওকে পালাতে হবে, পালাতেই হবে। দৌড় দেয় সে।কতটুকু দৌড়েছে জানে না। চোখ খুলে দেখে অন্য দুনিয়ায়, থুড়থুড়ে এক বুড়ি আপন মনে কি যেন বলেই যাচ্ছিল। উঠে বসতে গেলেই প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে সে।
বুড়ির কথা শুনে বুঝতে পারে সে- অনামিকা আর নেই। অনামিকাকে বাঁচাতে পারে নি দিপা।  
বুড়ির সাথেই থেকে যায় দিপা। বুড়ির এত মায়া বুড়িকে নিজের মা মনে হয়েছে তার। দিন যত যাচ্ছিলো যেন বুড়ির হারিয়ে যাওয়া রুপা হয়ে যাচ্ছিলো সে। বুড়ি দিপাকে রুপার প্রাপ্য ভালোবাসা সব দিয়েছিল। দিপার মায়া কাড়া চোখের সাথে রুপার চোখের যেন অদ্ভুত এক মিল! বুড়ি দিপাকে পেয়েও প্রতিনিয়ত রুপাকে খুঁজতে বেরোয়। রুপাকে খুঁজতে বেরিয়ে সে নিজেই হারিয়ে গেল।দিপা আবার একা হয়ে যায় এই ধরায়!

সপ্তাহ খানেক পর,
বিছানায় শুয়ে আছে দিপা।তার শরীর অনেক ভেঙ্গে গেছে এই কয়েকদিনে পানি ছাড়া কিছুই নেয়নি মুখে। কাজে যায়নি। পাপ্পুকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে। পাপ্পু যখন ভালোবাসি বলেছিল, তখন মুখের উপর দরজা লাগিয়েছিল দিপা।
দরজায় অনেক জোরে জোরে ধাক্কানো হচ্ছে। যেন ভেঙে ফেলবে।
দরজা খুলতে ইচ্ছে করছিল না দিপার, পাপ্পু না এটা নিশ্চিত জানে দিপা। সে গিয়ে দরজা খুলল। তার চোখ বিশ্বাস করতে পারছিল না তার ঘরের সামনে মেয়র স্বয়ং দাঁড়িয়ে।
আপনি?” আস্তে আস্তে বলে দিপা।
ছেলেটা কাঁদছে, খাচ্ছে না কিছু। এভাবে চললে তো মারা যাবে ছেলেটা...
দুঃখিত, আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন।
আপনার মায়ের খোঁজ দিব আমরা
কথাটা শুনেই দিপার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। সে কেন যেন মেয়রের পেছনে চলতে শুরু করেছিল নিজেও জানেনা। এর কারণ হয়ত মাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে সে।
এর দুইদিন পরই দিপার মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু আগের চেয়ে অনেক চুপচাপ। অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে তার চোখে। দিপাকে দেখে খুশি হলেও তার চোখ যেন কিছু বলতে চায়।
আর দারোয়ান সলিমুদ্দিনকে দিপার কথায় আবার সেই আশ্রমের চাকরিতে নেয়া হয়।নিজের গ্রামে চলে গিয়েছিলো সে।বড় আপার কাছে যায় নি। কেন যায়নি সে নিজেও জানে না। তার বাড়িতে যখন আশ্রমের বড় আপা আর দিপা আসলো তখন তার আর বিস্ময়ের সীমা ছিল না। আশ্রমে  রিপাকেও দেয়া হয় একটা ভালো পদে চাকরি। সেখানে থেকেই শাওনের দেখাশোনা করতে হবে তাকে।
বুড়ি মা যেদিন আসেন সেদিন দিপাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন, কাঁদেন অঝোরে। শাওনকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি কারণ তখন মেয়রের সেক্রেটারি ওখানে উপস্থিত ছিল।
সেদিন সকালে বুড়ি দিপার কাছে গিয়ে বললেন, মা বিয়ে থা করবি না? তোর এভাবে চললে তো হবে না। কারো হাত তোকে ধরতেই হবে। আমিও তো আর বেশিদিন থাকব না রে।
বুড়ির কথা শুনে চুপ ছিল দিপা। এরপর বের হয় শাওনকে নিয়ে। পাপ্পুর ওখানে যায় সে। অনেক দিন পর দিপাকে দেখে পাপ্পু অনেক অবাকই হয়েছিল।
দিপা বিকেলে ফিরে এসে দেখে তার বুড়ি মা নেই কোথাও।ভেবেছিল কোথাও ঘুরতে গিয়েছিল।
দারোয়ানের কাছে খোঁজ নিতে গেলে দারোয়ান তাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দেয়। আর কিছু বলে না দারোয়ান।
মা দিপা,
আমি লেখাপড়া জানি না তাই সলিম রে দিয়া লিখলাম। আমারর মনে হচ্ছে ওরা আমাকে বাঁচতে দিবে না। আমি পালাচ্ছি।
শোন,
শাওন যে ছেলেটা তোর কাছে সেটা আমার মেয়ে রুপার ছেলে। আমি তোকে কতবারই না বলেছিলাম তোর চোখের মায়া যেন পুরাটাই রুপার। শাওনও সে ভুলে পড়ে গিয়েছিল। মারে নাতি আমার ভুল করে নি। আমি বলতে পারব না তোকে কিভাবে আমার রুপা এই বড়লোকদের সাথে জড়াইছে কিন্তু এইটা জানি ওরা আমার রুপারে মেরে ফেলছে রে। আমি এটা বের করবোই। আমি তোদের কাছে ফিরে আসার আগে ওদের কাছেই বন্দি ছিলাম রে। আমি ওদের বাড়ির আশেপাশে ঘুর ঘুর করায় ওরা আমায় ধরে নিয়ে যায়। আমি এতটুকুই জানি রুপার ছেলে ও। বাবা বেঁচে থাকার পরেও যার কারণে ওকে দিয়ে আসা হয়েছে অনাথ আশ্রমে।
ছেলেটার খেয়াল রাখিস।
তোর মা।
চিঠিটা পড়া শেষ হইলেই সলিমুদ্দিন বলে, “আমি অনেক নিষেধ করছিলাম ওরে না যাইতে। কিন্তু আমার কথা শুনেনাই আমনের মা
দিপা ভারি গলায় বলে, “কোথায় গেছে বলতে পারো?”
দারোয়ান না সূচক মাথা নাড়ে।
দিপা ফিরে যাওয়ার সময় বলে, “আপা চিঠিটা যেন কারো হাতে না লাগে। সাবধানে!
দিপা চলে যায় ঘরে। তার মাথায় ভন ভন করে ঘুরতে থাকে কথাগুলো।শাওন তার কাছে এলে, তাকে জাপটে ধরে। নীরবে কিছুক্ষণ কাঁদে, সে বার বার আকুতি মিনতি করে মনে মনে যেন তার মা ফিরে আসে। দিপার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় পরদিন সকালে।
দিপাকে যেতে হয় তার মায়ের সাথে দেখা করার জন্য বুড়িগঙ্গার তীরে। জলে ভেসে বেড়াচ্ছে, বয়োজ্যেষ্ঠ এক নারীর নিথর দেহ।দিপা এই ধাক্কা সইলে পারলো না, গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে সে ওখানেই মাবলে। তার যেন দুনিয়াটা অন্ধকারে ভরে গেল। পানি থেকে উঠিয়ে যখন নিয়ে যাচ্ছিল, তখন দিপার ইচ্ছে হচ্ছিল মাকে জাপটে ধরতে। না, কিছু মহিলা কনস্টেবল কাছে ঘেঁষতে দিলো না।

মায়ের মৃত্যুর পরদিন,
মায়ের তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে কারা খুন করেছে আপনি আন্দাজ করতে পারেন?”
জি না।আমার মায়ের তেমন কোন শত্রু ছিল না যে উনাকে জানে মেরে ফেলবে!
অফিসার আরও কিছু প্রশ্ন করে চলে গেলো।

এর কয়েক মাস পর,
শাওন কে দেখতে এসেছেন মেয়র সাহেব। তিনি বসে আছেন, আশ্রম প্রধানের অফিসে। একজনকে পাঠিয়েছেন শাওনকে আনতে। যাকে পাঠিয়েছেন সে ফিরে আসে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে, শাওন আর দিপাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।
বহু বছর পর আবার এদিকটায় আসা হল ওর, চোখে ক্লান্তি আর গলায় তৃষ্ণা। তাকিয়ে সে সুদূর এক গাছপালা ঘেরা ছোট ঘরটার দিকে। যেখানে আগে দিপারা থাকতো। ছোটবেলা কাটিয়েছে সে যেখানে।তার পাশে দাঁড়িয়ে ছোট শাওন।তার হাত ধরে টান দিলো, “মা আর কতদূর?”
এইতো বাবা...আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখাল বাড়িটা ঐ নানার বাড়ি দেখা যাচ্ছে...
কি মজা, কি মজা নানার বাড়ি...উৎসাহে লাফাচ্ছে শাওন।
বুদ্ধিটা দিয়েছিলেন বড় আপাই। শাওন কে নিয়ে পালিয়ে যেতে। শাওনকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বড় আপা। তিনিই বলেছেন, মেয়রের কাছে লাগতে গেলে পরে তাকেও প্রাণ হারাতে হবে। তখন শাওনকে দেখার মত কেউ থাকবেনা।
শাওনের কথা চিন্তা করে সে রাজি হয়েছিলো...
কিন্তু সে জানে, কোন না কোনদিন রুপার সাথে মেয়রের সংশ্লিষ্টতা সে খুঁজে বের করবেই।
তার মায়ের প্রাণ বৃথা যেতে দিবে না সে।
চোখের কোনে পানি জমেছিলো। আঁচল দিয়ে মুছল তা। শাওনকে সাথে নিয়ে ধীরে ধীর চলল তার পুরান ঠিকানায়...।                        
                    সমাপ্ত
প্রিয় পাঠক, আপনি এতক্ষণ ধৈর্য ধরে গল্পটি পড়েছেন এজন্য আপনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। গল্পটি আপনার কেমন লেগেছে সেটা কমেন্টে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাতে পারেন। এবং আপনার যদি মনে হয় আপনার বন্ধুদেরও এটা পড়ে ভালো সময় কাটবে, তাহলে তাদের কাছে গল্পটি শেয়ার করতে পারেন।                                                   - মোঃ নোমান ভূঁইয়া 
                                                                               


গল্পটি একটি প্রতিযোগিতার জন্য লেখা হলেও, পরবর্তীতে এডিট করে প্রকাশ করা হয়, ২.১২.১৬ তারিখে। এখানে 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ