গল্প | আমি জোড়া খুনের আসামি



আমি জোড়া খুনের আসামি


রাত তখন তিনটে আমি শুয়ে আছি। আমার মোবাইলটা কোথায় যে রেখেছি খুঁজেই পাচ্ছি না। আলো জ্বালাতে হবে। কিছু বিদঘুটে শব্দে আমি তিক্ত-বিরক্ত।
আমি এসেছি এক নতুন জায়গায়। ঢাকা বরাবরের মতই আমার কাছে অপরিচিত। আর এই অপরিচিত রাজধানীতেই আমি এয়ারপোর্ট এলাকায় আমার একটু পুরনো বন্ধুর বাসায় উঠেছি।
আর আমি? আমি USA - তে গুগলের রবোটিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছি। আমি একটা রোবট বানাচ্ছি যেটা কাজের দক্ষতা আমাকে কালজয়ী উদ্ভাবক বানাতে পারবে। আমি দেশে এলাম আজ ৫ বছর পর ঈদ উদযাপনের জন্য। ভেবেই ভালো লাগে যে মা-বাবা, আমার দুই মেয়ে ও আমার রাণীর সাথে কতদিন পর দেখা হবে। তাদের আমি আমার সাথেই নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু নিইনি হয়ত আমার কাছে আমার কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই নয়, আর আমার কাজের জন্যে একা থাকাটাই বেশ জরুরী। কাজকে বেশি ভালোবাসায় পাষাণ হয়ে গিয়েছিলাম, ফিরিনি দেশে টানা ৫ বৎসর। আসার সাথে রোবটটার ব্রেইনিং ফাংশন, প্রসেসিং এরিয়ার ডেটা নিয়ে এসেছি। এগুলার উপর আরও অনেক কাজ করতে হবে।

হঠাৎ আজব শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চারদিকে ঘোরলাগা অন্ধকার। চার আঙ্গুল সামনের বস্তু দেখা যাচ্ছে না। আমার পাশে আরও দুজন শুয়ে মারুফ আর আরিফ। আর একজন নিচে শাইখ। শাইখ আমার বাল্য কালের বন্ধু। সুতরাং, একই রুমে আমরা চারজন।
“আহ, আহহহহ, আহহ”
কি অদ্ভুত শব্দ। তার সাথে আমার পাশের দিকে খাটে দুজনের নড়াচড়া। ছিঁহ!! ঘৃণায় মুখ আমার কুঁচকে গেল!!
আমার পাশে দুজন সমকামী!
লজ্জায় স্থান ত্যাগ করতে ইচ্ছা হচ্ছিল। যেহেতু এই এলাকায় আমি কিছুই জানি না হঠাৎ বেরুলে সমস্যা হবে। তাই কিছু না জানার ভান করে চোখ বুজে রইলাম।
“হু হু হু”
“হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ”
পর পর দুজনের একই রকমের চাপা শব্দ। শ্বাসকষ্টের মত!! কার শব্দটা লম্বা ছিল বুঝলাম না। কিন্তু ওদের জাতের সাথে যায় বেশ। তাই ভ্রুক্ষেপ না করেই আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
ভোরের কাছাকাছি সময়ে আমার আজব এক স্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্বপ্নটা ছিল এমন, “গায়ে আমার সাদা পোশাক, এর উপরে লেখা দুই খুনের আসামি আমি প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিলাম।পেছনে কয়েকটা ছায়া ধেয়ে আসছিল আমার দিকে। রাতে অতি বর্ষণের কারণে রাস্তায় পানি জমে একাকার। আমি সেই পানি উপেক্ষা করে দৌড়াচ্ছিলাম। হাঁপিয়ে উঠি অনেক, হাঁটুর গিঁটে ব্যথা শুরু হয়। এরমধ্যেই কিসের মধ্যে হোঁচট খেয়ে আমি পড়ে যাই ঝপাস করে পানিতে। আর ওদিকে ধেয়ে আসছে ছায়াগুলো এটার পর পরই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটা। হঠাৎ ফোন আসে শাইখেরমোবাইলটা বাজছিল দূরে কোথাও খাট থেকে নেমে হাতড়ে হাতড়ে শব্দের উৎসের দিকে এগুচ্ছিলাম।

মোবাইলটায় অনবরত ডাক আসছে, “ক্রিং ক্রিং, শাইখ ইজ কলিং।”
“শাইখ তো নিচে শোয়া, ও কল দিবে কেন??”
প্রশ্নটা মনে বাজতে থাকে বার বার। আমি লাইট টা জ্বালিয়ে দেখি নিচে শাইখ নেই।
তখন উপরে বিছানায় তাকাই।বিছানায় তাকানোর সাথে সাথে চোখ আমার কপালে উঠার উপক্রম। বিছানায় দুজনের মুখে দুটো পলিথিন জড়ানো। ভেতরে বাতাস প্রবেশের সুযোগ যে নেই। আমি হাত নেড়ে চেড়ে দেখলাম। ওদের নাড়ি অচল।ওদের মৃত্যু হয়েছে।
তার মানে???
তার মানে ঐ সময়ের শব্দগুলো তাদের মৃত্যুর পূর্বকালীন শব্দ ছিল!!!
আমার তাড়াতাড়ি পুলিশ ডাকা উচিৎ। তাড়াতাড়ি মাঝের রুমে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা মোবাইলটা হাতে নেই। আরেকবার অবাক হলাম আমি “৩৭ টা কল আর ১৫ টা মেসেজ”
সবই একটা নাম্বার থেকে “শাইখ”
প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে আসতে আসতে জমা হয়েছে এগুলা।
আমি কল ব্যাক করলাম।
“আরে শাইখ, তুই কই????”
“আগে বল, তুই কই?? প্লাইট থেকে নেমে কোথায় গেছিস? তুই তো ঢাকায় কাউকে চিনিস না।”
“আমি এদিকে কোথায় আছি বুঝতে পারছি না রে”
কল কেটে গেল। না আমার মোবাইলের চার্জ শেষ ওটা বন্ধ হয়ে গেছে।
আমি আরেকবার আকাশ থেকে পড়লাম। একি শুনছি আমি। আমি এতক্ষণ শাইখের সাথে ছিলাম না??? কার সাথে ছিলাম? আশ্চর্য আমি আমার বাল্য কালীন বন্ধুকে না চিনে অন্য কোন লোকের বাসায় এসেছি যে কিনা একজন খুনি।
আমি ভেতরের রুমে আমার ব্যাগ টা খোঁজা শুরু করি। সেখানে ১৫ ভরি স্বর্ণ ছিল আর প্রায় দেড় কোটি ডলার মূল্যমানের রবোটিক ডেটা। দামটা এতটা চড়া আমার জানা ছিল না, গত মাসে আমার আবিষ্কৃত ডেটা বিজ্ঞানী ড এম এস এইচ শাওন দেড় কোটি ডলার দিয়ে কিনতে চেয়েছিলেন।
এগুলা চুরি হওয়া মানে আমি নিঃস্ব হয়ে যাওয়া আর আমার সাম্প্রতিক প্রোজেক্টের কয়েক বছরের জন্য পিছে চলে আসা। আর এগুলা কোন বিশেষ হাতে পড়লে তো আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।
হঠাৎ সাইরেন বাজছে। পুলিশ আসা শুরু করেছে মাত্র।
আমি কল করেছিলাম? না তো!
তাহলে??
পুলিশ এখন এসে নিশ্চয়ই আমাকে দোষী ভাববে। আর আমার কাছে নিজের পরিচয় দেয়ার মত কিছুই নেই। মোবাইলটা দূরে ছিল তাই ওটা নিতে সময় পায়নি খুনি আর বাদবাকি সব নিয়ে গেছে।
আমি তড়িঘড়ি করে পালাবার পথ খুঁজতে লাগলাম। রেলিং বিহীন বারান্দাটার দিকে চোখ গেল! আমি দৌড়ে লাফ দিয়ে বসি দোতলা থেকে। নিচে গিয়ে বালুর স্তূপে পড়ি তাই এই যাত্রায় বেঁচে যাই। আমি এখন দৌড়চ্ছি। প্রাণপণে। পিছনে পুলিশ আসছে। তাদের সাইরেন আমার মনে ভয় আরও বৃদ্ধি করছে।
হঠাৎ মনে প্রশ্ন এলো, “আমি কি করলাম?”
মন উত্তর দিলো, “তুই জোড়া খুন করেছিস”
আমি বললাম, “না আমি করিনি”
মন বলল, “ঐ সময় খারাপ চিন্তা মাথায় না এনে লাইট জ্বালিয়ে দেখলে তুই খুনিকে ধরতে পারতি। আর তোর ডেটাও হারাতো না।”
আমি আফসোসে চোখের পানি ঝরাতে লাগলাম। খুনি আমার জন্যে কোন পথই খোলা রাখেনি। আমার হঠাৎ মনে হল যে খুনি আমাকে কেন মারেনি?
খুনি আমাকে মারেনি কারণ সে আমাকে পুরোপুরি বরবাদ করতে চেয়েছিল। আমি মারা গেলে হয়তবা আমি ভালো মানুষ হিসেবেই মারা যেতাম আর এখন দেখা যাচ্ছে আমাকে দুটো খুনের দায় মাথায় নিয়ে মরতে হবে, যা আমি কোনদিনই চাইনি। নিজেকে আমার নির্দোষ প্রমাণ করতেই হবে।

আমি দৌড়চ্ছি, “আমি জোড়া খুনের আসামি!!!”  

্বপ্নে মতই হঠাৎ করে পড়ে গেলাম আমি! ছায়াগুলো আরও স্পষ্ট হচ্ছে। ওরা আরও কাছে আসছে।আমি উঠতে চাইলাম, না পারলাম না। পায়ে অনেক ব্যথা করছে। পেছনে হাত ফেলে ফেলে সরে যাচ্ছি আমি।ওরা আমার আরও কাছে এসে গেছে। না, ওরা পুলিশ নয়, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ওদের কাপড় স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে।

ওরা রাতজাগা হায়েনা। রাতের আঁধারে শিকারের জন্য ওঁত পেতে থাকে, শিকার এলেই ওদের দরকার শিকারের অক্ষত সব অঙ্গ।
আমাকে উঠে পালাতেই হবে, কিন্তু পারছিনা।

আমার সামনে ঘটে যাওয়া জোড়া খুন যে আমি করিনি, আমাকে তা প্রমাণ করতেই হবে। কিন্তু পারছি না উঠতে, পারছি না দৌড়াতে।
এখন আমি আসন্ন কালো ভবিষ্যতের অপেক্ষায় আছি। ওরা আসবে, আমায় নিয়ে যাবে আর কতিপয় অঙ্গাণু কেটে নিয়ে যাবে।

আমার মাতৃভূমে আমি বিজ্ঞানী না হয়ে, জোড়া খুনের আসামী হয়ে মারা যাব(!!) ভাবিনি। আমি চোখ বুজে ফেললাম, ওরা আমার আরও কাছে এসেছে, তখন একটা চেহারা আমার চোখে ভেসে উঠল আমার রানী, আমার  নীরার চেহারা ।শাইখ যাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। আজ সেই নীরা আমার  দুই কন্যার মা। তার কাছে যেতে বেশ ইচ্ছে করছে। মেয়েগুলোর কাছে যেতে বেশ ইচ্ছে করছে। ওদের ছোট ছোট হাতের স্পর্শ আমাকে এখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে

পরিশিষ্টঃ
হা হা হা হা, হেসেই চলেছে আঁধার মায়ায় কেউ একজন।
তার হাতে একটি বড় সড় ব্যাগ। কিছু  কথা ভেবে তার অনেক ভালো লাগছে।
আবার একজনার কথা, একজনার হাসির কথা মনে পড়তেই তার বুকের বাম পাশ টা চিন চিন করে উঠল।
আজ তার বদলা পূরণ হয়েছে। এভাবেই একদিন তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, তার জীবনের উদ্দেশ্য নীরাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল বন্ধু নামের কলঙ্ক “নোমান” নোমানকে সে এমনভাবে নাস্তানাবুদ করেছে যে কারো, এমনকি তার নিজেরও বোঝার উপায় নেই।
আজ সে নোমানের জীবনের সবচেয়ে দামি জিনিসটি ছিনিয়ে এনেছে তার যুগান্তকারী আবিষ্কার আর এক যুগ ধরে অর্জন করা যশ-খ্যাতি, সম্মান। আজ সে বিজ্ঞানী নয়, নিছকই দুই খুনের আসামি। যার আজ মৃত্যু ছাড়া কোন পথই খোলা নেই।    
                
                                 সমাপ্ত 
লেখা ভালো লাগলে ফেসবুকে শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়তে দিন 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ