গল্প | তুমি আসবে বর্ষায়


                                  অধ্যায় ১ 

                                                                   একটি নতুন সত্য

এক
মিম চা এনে রুমে ঢুকতেই তার কানে ভেসে এল গিটারের সুর। কেউ একজন গিটার বাজাচ্ছে। বাইরে কুকুর বিড়াল বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির দরুন চারিদিকে এক ধরনের থমথমে ভাব,  আবার বেশ ঠান্ডা ও
আকাশে ঘন মেঘের কারণে চারদিক বেশ অন্ধকার হয়ে আছে। হঠাৎ রুমের ভেতরকার লাইট অফ হয়ে গেল; লোডশেডিং এর ফলে রুমটিও গাঢ় অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যায়। মিম চায়ের কাপ রেখে, টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি মোম বের করে জ্বালাল। আচ্ছা এতক্ষণ শুনতে পাইনি কেন? জিজ্ঞেস করল নিজেকে। নিজেই উত্তর দিল, নিচতলায় রান্নাঘরে থাকাতে হয়ত শুনতে পাইনি!
         ঠান্ডা অন্ধকারাচ্ছন্ন থমথমে আবহাওয়ায় হঠাৎ গিটারের সুর কেমন যেন অপার্থিব অপার্থিব লাগছে মিমের কাছে। মিমের বিস্ময়ের সীমা রইল না, কে বাজাচ্ছে এত সুন্দর করে গিটার? সে মোমবাতিটি চায়ের কাপটির পাশে রেখেই জানালার কাছে গেল। গিটারের সুর তাকে মোহিত করেছে, সে এই বৃষ্টি উপেক্ষা করে জানালার একটি কপাট খুলে দিল। মুহূর্তেই বৃষ্টির ছাঁট এসে মিমের চোখ মুখ ভিজিয়ে দিল এবং ক্রমাগত একই কাজ করে চলছে। মিমের পুরো শরীর জুড়ে অজানা এক শিহরণ বয়ে চলে যায়।   জানালার গ্রিল ধরে মিম চোখ বন্ধ করে ফেলল। কানে বাজছে গিটারের সুর আর বৃষ্টির ঠান্ডা ছোঁয়া, যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। মিম ভাবল, নাঈমুল?  না নাঈমুলকে তো মিম কখনও গিটার বাজাতে দেখেনি। তাদের বিয়ের আজ ৫ মাস হল। নাঈমুল যদি গিটার বাজাতে জানত তাহলে এতদিনে তাকে অবশ্যই বাজিয়ে শোনাত। না, নাইমুল এমনটি করেনি। অবশ্য তাকে দেখেও মনে হয় না তার গিটারের শখ থাকতে পারে। নাঈমুল যে গিটার বাজাচ্ছে এ চিন্তা সে মুহূর্তেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল। মনে মনে বলল, যে এমন সুন্দর করে গিটার বাজাতে পারে তার গানের গলাটা জানি কেমন হয়!

গিটারবাদক যেন মিমের আকুতি শুনতে পেল। বাতাসের ঝাপটা এসে পড়ল মিমের মুখে। তার খোলা চুল মুখের এপাশে চলে আসতেই সে দিল তা চোখ বন্ধ রেখেই। মোমবাতিটি নিভতে গিয়েও নিভেনি। মোমবাতি রাখা টেবিলটি জানালা বরাবর না হওয়ায় বাতাস মোমবাতিরর টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। গিটারের সুর থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। মিমের কাছে মনে হল যেন কয়েক প্রহর। গিটারের সুর আবার ভেসে আসা শুরু করেছে। আর তার সাথে হাল্কা গাম্ভীর্য মাখা একটি কন্ঠের আকুতি ভেসে আসছে....
 
    তুমি আসবে বর্ষায়....
    প্রিয়তমা গো....তুমি এসো বর্ষায়
    মেঘেদের ভেলায় চড়ে...যেমনটি এসেছিলে  
    বহুকাল আগে সাদায় আর বর্ষায় মাখামাখি হয়ে...  
    তুমি আসবে বর্ষায়....ছুঁয়ে দিবে আলতো করে...
    ভূলে যাব যেন সব দুঃখ এক ছোঁয়ায়...
    প্রিয়তমা গো....
    তুমি এসো বর্ষায়....
    কালো মেঘের পর্দা সরিয়ে নূর হয়ে
    তুমি আসবে বর্ষায়.....

হঠাৎ যেন কিসের শব্দ হল ঘরে। মিম বুঝতে পারল না কিছু। বিড়াল টিড়াল বোধহয়। হঠাৎ তার মনে পড়ল নাঈমুল কোথায়? তার জন্যে চা এনেছি, ঠান্ডা হয়ে গেল যে! চা হাতে নিয়ে দেখল- যাহ্ বাবা! এ যে ঠান্ডা হয়ে একেবারে শরবত হয়ে গেল। এখন কি করা? থাক পড়ে এমনিতে। এই বৃষ্টি বাদলের দিনে হঠাৎ ফুড়ুত?
চা- এর আবদার করে কেউ কখনও এভাবে ফুড়ুৎ হয়েছে? আল্লাহ্‌ মালুম!
মিম চায়ের কাপ ফেরত নিয়ে চলে যাচ্ছে এমন সময় ওভারড্রোব এর দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল। মোমবাতির আবছা আলোয় দেখতে পেল তাদের ওভারড্রোব এর সবচেয়ে নিচের ড্রয়ার টি খোলা।
মিম বেশ অবাক হল, ওমা! ড্রয়ার টা যে খোলা! কে খুলেছে?

এ ড্রয়ার টিকে সবসময় তালাবন্ধ থাকতে দেখেছে সে। তাদের বিয়ের পাঁচ মাস সময়ে কাউকে এ ড্রয়ারটি ছুঁতে পর্যন্ত দেখেনি। একবার নাঈমুল কে জিজ্ঞেস করায় সে এড়িয়ে গিয়েছিল। আজ এ ড্রয়ারটিকে খোলা দেখে তার ভেতরে এর রহস্য ভেদ করার লোভ জন্মাল। যার কারণে গিটারের সুর আর তার মনোযোগ কাড়তে পারছে না।

দুই          
ড্রয়ারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়, খাটের পাশে নিচে প্লোরে তার চোখ আটকে গেল; বুক ধক করে উঠে। ঠোঁট কাঁপছে। তার মনে হাজার প্রশ্নের একটি, “নিচে এই কার ছবি?” ছবিটা হাতে নিল সে।
একজন সুন্দরীর ছবি, কোন এক শিল্পীর নিজ হাতের অনবদ্য চিত্রকল্প যেন! ছবিটার পিছনে লেখা, “রাইসার ২২ তম জন্মদিনে তোলা ছবি”।

এত দিনে একবারের জন্যও যে ড্রয়ারটি কাউকে খুলতে দেখেনি সেই ড্রয়ার খুলে যা অপ্রত্যাশিত, সে তা-ই দেখতে পেল। রাইসা মেয়েটির অসংখ্য ছবি, একটা ডায়েরি, কতকগুলা চিরকুট। একটা হাল্কা গোলাপি রঙ্গের চিরকুট হাতে নিল সে। মেয়েলি হাতে লেখা:

“নাঈমূল,স্যরি, স্যরি, স্যরি... ...স্যরি।
 জানু আর এমনটা হবে না। প্লীজ, প্লীজ।কোথায় তুমি?
 কল ধরো না কেন?
                ...রাইসা”।

আশাহত হয়ে খাটে ধপ করে বসে পড়ে মিম। তার স্বামীর প্রেমিকা আছে? সে এটা আশা করে নি। কত স্বপ্ন দেখেছিল নাঈমূলের সাথে। সব এক পলকে মিশে গেল খুড়কুটার স্তুপে। কুকুর- বিড়ালের বৃষ্টি বেড়ে তীব্র হচ্ছে। সাথে নাঈমূলের গান ও। বাইরে ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে। নাঈমুলের গিটারের ধুন তীব্র হচ্ছে আর তার কন্ঠে আকুলতা, “তুমি ফিরে এসো বর্ষায়.. প্রিয়তমা গো” এদিকে একজনের চোখের পানি টপটপ করে ঝরছে আর দৃষ্টি আটকে আছে কতিপয় বস্তুর দিকে। ডাইরীটার দিকে আগাচ্ছে সে।

ছাদে অবিরাম ভিজছে নাঈমুল। নাঈমুলের মায়ের শ্রবণশক্তি কম, আর তার বোন ভার্সিটিতে; তাই তাকে কেউ বারণ করতে যাচ্ছে না। এখন বর্ষায় নাঈমুলের আসন্ন বিপদ থেকে কিংবা আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বাকী রইল মিম। সে-ই এখন উদাসীন। সে জানেনা অনেককিছুই, যার কারণে হয়তবা হারাতে হতে পারে তার স্বামীকে।

তিন
ঝুপঝুপ বৃষ্টির মাঝে মোহের মত বাজিয়ে যাচ্ছে গিটার নাঈমুল। অনেকক্ষণ ধরে ভিজার কারণে তার শরীরের যা তা অবস্থা। মাথাটা যেন ফেটে যাবে এমন মাথাধরা। কিন্তু তার কোন বিকার নেই- একমনে বাজিয়েই যাচ্ছে। আর মন চাচ্ছে তো দু-এক বুলি গান আউড়িয়ে চলছে সে।

গিটার ছিল রাইসার অনেক প্রিয়, রোজ রোজ রাইসাকে বাজিয়ে শোনাত নাঈমুল। মাঝে মাঝে দুজন মিলে গাইতো গান। রাইসা না থাকায় সে আর এই গিটার তেমন বাজায় না। লুকিয়ে রেখেছিলো নিজের ওয়ারড্রবে।
হঠাৎ হঠাৎই তার গিটার একদিনের জন্য বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলে। দিনটিই এমন- নাঈমুল আর রাইসা যেদিন প্রথবারের মত একসাথে বৃষ্টিতে ভিজেছিলো। দিনটি কখনো ভুলার মত ছিল না নাঈমুলের কাছে; সে ভুলেনিও।

তাই তো শ্রাবণের এই দিনে তার গিটার প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। তার কেন যেন মনে হয় রাইসা ফিরবে এরকমই বর্ষামুখর দিনে। যেরকমটা এসেছিলো ঠিক দুবছর আগে। যেদিন তারা একজন আরেকজনের কাছে হয়ে উঠেছিল একান্ত আপন। আজও তার চোখে ভাসে সেই দিন- যেদিনের হাত ধরে মরতে বসেছিল সে আর চিরস্থায়ী রুপ নেয় তাদের সম্পর্ক। আচ্ছা রাইসার কি আজও দিনটির কথা মনে আছে??? কথাটা মনে হতেই বাড়ির পেছনের দিকে সামান্য উঁচু জায়গাটির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখ থেকে পানি পড়ছে। হাত গিটারের স্ট্রিং এ দিচ্ছে করুণমাখা সুর।

                                                                          ***
হতভম্ব হয়ে বসে থাকা মিম যেন চেতনা ফিরে পেল আশেপাশে কোথাও বাজ পড়ায়। সব চিঠিপত্র সরিয়ে ডাইরিটা হাতে তুলে নিল সে।
হাতে নিয়েই ডাইরিটার পৃষ্ঠা উলটানো শুরু করল। মেয়েটা কে? এই প্রশ্নের উত্তর এই ডাইরীতে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটির পর মিম বুঝতে পারল ডাইরীটা আসলে নাঈমুলের নয়, ডাইরীটা যেকোন মেয়ের হতে বাধ্য। আবার ফ্রন্ট পেজে ফিরে এসে নাম টা দেখে নিল, নামটা- রাইসা আনোয়ার!

কিছুক্ষণের জন্য থ মেরে রইল মিম। লেখাটায় আরেকটাবার দেখে নিল। "রাইসা সুলতানা" নামটার "সুলতানা" কেটে তার পাশে বসানো হয়েছে রাইসা আনোয়ার!
ভাবতেই পারছে না মিম। এ কি দেখেছে সে?

রাইসা তার স্বামীর প্রেমিকা নয়, স্ত্রী?
নাঈমুল আনোয়ার এর স্ত্রী রাইসা আনোয়ার?
এ কি করে সম্ভব? মিম তাহলে নাঈমুলের দ্বিতীয় স্ত্রী? তার সাথে তাহলে প্রতারণা করা হয়েছে??

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ