গল্প | এই নববর্ষ অন্য কথা বলে

Ei Noboborsho Onno Kotha Bole - MD Noman Bhuiyan (MAANBhA)
 
(গল্পের পেছনের গল্পসহ)
এই নববর্ষ অন্য কথা বলে
- মোঃ নোমান ভূঁইয়া


ঘরের একপাশ হতে অন্যপাশে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে অতুনু। তার মন অনেক অশান্ত হয়ে আছে। হাতঘড়ি দেখে নিল সে, নয়টা বাজে। আর বেশিক্ষণ নেই। আলনার কাছে এসে পাঞ্জাবীটা হাতে নিল সে। তার মাথায় এখন দুধরনের ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তার সামনে দুটো রাস্তা চলে গেছে দুদিকে। প্রথম রাস্তার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আরশিতা। আর অন্য রাস্তাটা চলে গেছে তার ঠিক উলটো পথে টাওয়ার হাসপাতালের তৃতীয় তলার তিনশ চার নাম্বার রুমে। যেখানে নাফিস ভাইয়ের মা আছেন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। তাঁকে বাঁচানোর জন্যেই এই নববর্ষের দিনে এক ব্যাগ রক্তের খুব প্রয়োজন। নাফিস ভাইয়ের মায়ের প্রতিবার ডায়ালাইসিস করানোর সময় নতুন করে এক ব্যাগ রক্ত লাগে আর আজকেই উনার ডায়ালাইসিস করানোর শেষদিন। রক্তের ব্যবস্থা না হলে উনার অবস্থা খুবই বাজে হতে বাধ্য। এই নাফিস ভাইয়ের মা’কে অতুনু আগেও দুবার রক্ত দিয়েছিল, হাসপাতালে গিয়ে দেখতে যায় নাফিস ভাইয়ের মাকে। কেবিনের দরজা ঠেলে ডুকেই সে টের পায়, তাকে একধরণের বিষণ্ণতা গ্রাস করে ফেলেছিল; সে দেখেছিলো অক্সিজেন মাক্সের ভেতর যে মহিলাটার মুখের অবয়ব দেখা যাচ্ছিলো তা যেন তার মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগের ছবির সাথে খুব মিলে যায়। তখন তার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মা রোড এক্সিডেন্ট করেও যে কয়দিন বেঁচে ছিলেন, সে কয়দিনের মায়ের সাথে বলা কথাগুলো, উফ! কি যন্ত্রণা। মায়ের কথাগুলো তার কানে কুয়াশার আর শব্দের মিশ্র অনুভূতি জাগিয়ে তুলছিল তখন। সে এগিয়ে যায়, নাফিস ভাইয়ের মায়ের দিকে, সুপ্তি নামের মেয়েটি অক্সিজেন মাস্ক সরায় মায়ের নির্দেশে। স্ট্রোক করার কারণে, মাস্কবন্দী হয়ে পড়েন নাফিস ভাইয়ের মা। উনি অতুনুকে বসতে বলেন, সে বসে- কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উনি বলেন, “বাবা, কেমন আছো?” গলগল করে চোখের পানি পড়ার আগ মুহূর্তে সে বলে, “আমি ভালো আছি, মা- তুমি কেমন আছো?”
এই তো বাবা...” উনি কথা শেষ করার আগেই হাঁপানি উঠলে, অক্সিজেন মাক্স আবার লাগিয়ে দেয় সুপ্তি। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অতুনু তখন রুমের থেকে বাইরে চলে আসে।
অন্যপথের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আরশিতা। অতুনুর জন্মদিন ছিল ১০ই এপ্রিলে, সেদিন আরশিতাকে প্রপোজ করে বসে সে। যখন হাউজ পার্টির এক ফাঁকে দুজন আকাশ দেখার জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তখন আচমকাই আরশিতার হাত ধরে অতুনু হাঁটুগেঁড়ে বসে পড়ে আর জিজ্ঞেস করে, “আরশিতা, তুই কি আমার সারজীবনের পথ চলার সঙ্গী হবি?”
ঐদিন আরশিতা বেশ বিব্রত বোধ করে, কারণ তাকে যে প্রপোজ করেছে সে আর কেউই নয় তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু “অতুনু” যার অনুপস্থিতি তাকে কখনোই শান্তিতে থাকতে দিত না। তাই অপ্রস্তুত আরশিতা তার কাছ থেকে কিছুদিনের সময় চেয়ে নেয় আর বলে দেয়, যেন কোনভাবেই আরশিতার সাথে যোগাযোগ না করার চেষ্টা করে অতুনু।

হঠাৎ গতকাল,
রাত তখন বারোটা কি একটা বাজে, বারান্দায় নিজের বেহালাটা হাতে নিয়ে বাজানোর চেষ্টা করছিল, অস্থিরতা দূর করার জন্যে। কারণ রাতের আঁধার কেটে গেলেই; নতুন আরেকদিন। বাংলা বছরের প্রথমদিন; পহেলা বৈশাখ। এদিনে তার আর আরশিতার একসাথে বের হওয়ার কথা, কিন্তু প্রপোজের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন কথাই হয় নি।
অস্থিরতা বাড়ছে, বেহালায় মনোযোগ দিতে পারছে না সে। এরকম তার কখনই হত না, কিন্তু আজ দিনটা যে ভিন্ন। ভাবছে গভীরভাবে সে, আরশিতা কে কি আমি কল দিবো? না, থাক। তারই তো দেয়ার কথা। সেই তো বলেছিল, “নববর্ষের আগে আমাদের আর কথা হবে না, যা বলার ঐদিনই বলব আমি”।
আচ্ছা কাল যদি দেখা হয় কি বলব আমি? এসব ভাবার এক ফাঁকে তার মোবাইলের দিকে চোখ গেল। তার রুমে খাট নেই। জাজিমের উপর একটা পাতলা চাদর, একটা বালিশ একটা কোলবালিশ- এগুলো নিয়েই তার শোবার জায়গা। বারান্দা থেকে সব কিছু একেবারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মোবাইলটাকেও দেখতে পেল সে, রিং হচ্ছে। কলার আইডি দেখেই সাথে সাথে চিনে ফেলল সে, দ্রুত বারান্দা থেকে রুমে চলে আসে। কল ধরে কম্পিত গলায় বলে, “হ্যালো”
ওপাশ যেন কিছুক্ষণ নীরব ছিল তারপর হঠাৎসরব হয়ে দ্রুত বলেগেল, “কাল চলে এসো আমার প্রিয় রেস্টুরেন্টে । ঠিক সকাল দশটায়। এর এক মিনিট ও যেন দেরী নাহয়”।
তার হৃদয়ের হাতুড়িপেটাটা হাল্কা দমিয়ে বলল সে, “অকে আমি চলে আসব, একটুও দেরী হবে না, তুমি চিন্তা করোনা”।
আহ, অবশেষে সে কল করেছে। নিজের মনে কেমন এক প্রশান্তির অনুভূতি বয়ে গেল তার। মন ভালো কিংবা অতিরিক্ত বিষন্নতায় ভুগলে, অতুনু দারুণ বেহালা বাজায়। যেই মাত্র সে সুর তুলুতে যাবে নিচ তলার বুড়ো আঙ্কেলটি চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই সময়ে বেহালা বাজায় কেউ?” তার গলার আওয়াজ পেয়ে চারপাশের অনেক জানালায় আলো জ্বলে উঠল। অতুনু দ্রুত বারান্দা থেকে সটকে পড়ে। শুয়ে পড়ে। ভেতর থেকে কেউ একজন বলছে, অতুনু আরশিতা তোকে এই প্রথম ‘তুমি’ করে বলেছে, গুড লাক ম্যান। কালকে নিশ্চিত আরশিতা তোকে রিটার্ণ আই লাভ ইয়্যূ বলবে দেখে নিস। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমা। আর হ্যাঁ ব্রো, মোবাইল টা আজকে অন্তত চার্জে লাগাইয়া ঘুমা। নাহয় দেখবি সকাল সকাল আবার ব্যাটারি বাবা মরে পড়ে আছে, আর তোর লাভ স্টোরির এখানেই অন্ত হয়ে যাবে। অতুনু নিজের ভেতরের মানুষটাকে “জি বস” বলে মোবাইলটা চার্জে লাগিয়ে- আবার শুয়ে পড়ল। তার অশান্ত মন শান্ত হতে হতে তাকে গভীর ঘুমে তলিয়ে নিয়ে যায়।
পাঞ্জাবীর দিকে একমনে চেয়ে থাকতে থাকতে গতরাতের কথা তার চোখে ভেসে আসছিলো, পাঞ্জাবীর দিকে ভালো করে তাকাতেই তার মনে হল গত বছরের ঘটনাটি, গতবছর পহেলা বৈশাখে সব বন্ধুরা মিলে ঘুরে বেড়ানোর একসময় অটোরিকসার এক জায়গায় তার পাঞ্জাবীটা আটকে যায়। সে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা যখন করছিলো আরশিতা তার হাত ধরে হঠাৎ টানদেয়। যার ফলাফল তার পাঞ্জাবীটা ছিঁড়ে যায়। অতুনু অনেক মন খারাপ করেছিলো, কারণ তার প্রয়াত মা বেঁচে থাকতে তার জন্মদিনে পাঞ্জাবীটা উপহার দিয়েছিলেন যা তার মায়ের দেয়া শেষ উপহার। বান্ধবী আরশিতাকে সেবার বকেছিলো খুব। বকলেও পরে ঠিকই স্যরি বলে দেয় আরশিতাকে। এর দুদিন পরেই আরশিতা টিউশনির বেতন পেয়ে হাল্কা নীল রঙ্গের পাঞ্জাবী গিফট করে বসে অতুনুকে । ঐ পাঞ্জাবীই এখন অতুনুর হাতে। তাই স্মৃতির পাতায় আরশিতার কথাই বার বার ভেসে আসছে।
আরশিতাকে নিয়ে এসব কথা ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ল আরশিতা মেয়েটা জিদ্দি অনেক, হয়ত আজকে সময়মত দেখা না করতে পারলে আরশিতার সাথে আর কথাই বলা হবেনা ওর, এসব ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্তের পাল্লাটা যে কখন আরশিতার দাঁড়ানো রাস্তার দিকে ঝুলে পড়েছে সে টেরই পায়না, এ পথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়; তখন দেখা গেল তাকে তার মা ডাকছেন; যার কন্ঠের সাথে খুব মিলে যায় নাফিস ভাইয়ের মায়ের কন্ঠ; সে শুনতে পায় মায়ের কিডনির ব্যথায় গোঙ্গানি; ডায়ালাইসিস পূর্ব বেদনা। সে ছুটে যেতে চায়, কারণ নাফিস ভাইয়ের মাকে নিজের মা ভেবে বসে আছে, আর তার সাথে তীব্র মানবিকতাবোধ। এবার ভুলোমন ওদিকে পা বাড়াতে চাইলে, দেখা যাচ্ছে, ডাকছে আরশিতা। সে অতুনুকে বলছে, তোমার কাছে আমার যে কোন মূল্য নেই; সারাজীবন কি ভালোবাসবে আমায়?
এসব ভাবতে ভাবতে সে যেন একটি কানাগলির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, কিংবা অচেনা পথের চৌরাস্তায়। কোন পথে যাবে সে? মাইগ্রেনের ব্যথা উঠতে শুরু করে; যেন এই প্রশ্নই এযাবতকালে পৃথিবীর সবচেয়ে জটিলতম কোন প্রশ্ন। হঠাৎ, একটা প্রশ্ন তার মাথায় খেলা করে, আচ্ছা রক্ত দেয়ার শেষ সময় আজ হলেও- এখন তো মাত্র সকাল; সারাদিন সময় আছে; বেলা করে রক্ত দিয়ে আসলে নিশ্চিত কোন ক্ষতি হবে না? পাঞ্জাবীটা খাটে ছুঁড়ে ফেলে খাট থেকে মোবাইলটা উঠিয়ে নিল; নাফিস ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করলো অতুনু।

দুই
টাওয়ার হাসপাতালের তৃতীয় তলার তিনশ চার নম্বর রুম।
কেবিনের বাইরের সোফায় শুয়ে ছিল নাফিস, ঘুম ভাঙতেই চারপাশে একবার তাকিয়ে কেবিনের ভেতরে যায় সে, মায়ের বেডের পাশে রাখা টুলে বসে। মায়ের মলিন মুখের দিকে একমনে চেয়ে থেকে আপনমনে বললো, মা তুমি ঠিক হবে কবে? মায়ের এক হাতে চুমো খেয়ে চোখে মুখে ঘষল সে। এতে তার মায়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়, হাতের স্পর্শেই বুঝে যান তিনি এ যে নাফিস। তিনি হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করেন, “কিরে কিছু বলবি”
নাফিস চোখের কোণায় জমে থাকা জলকণা মুছে মুছে বলল, “কিছুনা মা, তুমি ঘুমাও। আমি তোমার জন্যে নাস্তা নিয়ে আসি”
নাফিস উঠে দরজার কাছে এগোনোর আগেই তার বোন সুপ্তি আসে, হাতে ট্রে আর ওটাতে গরম স্যুপের বাটি। মায়ের জন্য সকালের হাল্কা খাবার এনেছে। সুপ্তি আর নাফিস মিলে তাদের মাকে নাস্তা খাইয়ে দেয়, এর কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আসেন রুটিন চেকাপের জন্য, রুটিন চেকাপ করেই নাফিসকে জানায় যে ডায়ালাইসিস আজই সেরে ফেলতে হবে। নাহয় অবস্থা আরো ক্রিটিকাল হয়ে যাবে। সে জানে, ডাক্তার এমন কেন বলছেন; এখন স্রেফ আর কিডনীর সমস্যায় নেই তার মা।
ডাক্তার চলে গেলে হাসপাতালের করিডোরের শেষপ্রান্তে দাঁড়ায়, যেখান থেকে টাওয়ারের সামনের রোডটা চলে গেছে, বহু যানবাহন আর নানান রঙের মানুষের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে সে তার ভাবনার শেষ নেই। ছোট্ট চাকরি এতেই মায়ের এতকিছু, বোনটার পড়ালেখা, ছোট ভাইটার দেখাশোনা। আর বাবা, উনি তো কবেই আমাদের কে একা এই নিষ্প্রাণ পৃথিবীতে রেখে চলে গেছেন নিজে অপার সুখের স্থানে।
একটা ব্যাপার তাকে খুব ভাবিয়ে তুলছে, তার মায়ের রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। আর সঞ্চরণ, যেখান থেকে রক্ত সংগ্রহ করে থাকে তাদের হিসাব অনুযায়ী কুমিল্লা শহরে ৩/৪ জনের রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ- যারা কোন না কোন সময় রক্ত দিয়ে গেছিলো সঞ্চরণে। সে দুদিন আগে খোঁজ নিয়ে দেখেছে, এদের মধ্যে যে দুজনকে পাওয়া গেছিলো- তাদের মধ্যে একজন এক দেড় মাস আগেই অন্যত্র রক্ত দিয়ে ফেলেছিলো। অন্যজন তাকে রক্ত দিতে আসবে বলে আশ্বস্ত করলেও, পরে আর আসেননি। গতকাল, কুমিল্লার সব ব্লাড ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখে সে, যেখানে সর্বসাকুল্যে ব্লাড ব্যাংক মাত্র দুই কি তিনটা কুমিল্লার মত ছোট শহরে। তাদের রিজার্ভেও ও নেগেটিভ রক্ত পাওয়া যায়নি। একেবারে মুষড়ে পড়ে সে, তখন মনে পড়ে অতুনু ভাইয়ের কথা। যিনি পূর্বে আরো দুইবার তার মাকে রক্ত দিয়েছিলো।
হঠাৎ তার মোবাইলে রিং হতেই চমকে উঠে কিঞ্চিৎ, মোবাইলটা বের করে দেখে অতুনু ভাই কল করেছে। অতুনু তার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও ভাই বলে সম্বোধন করতেই পছন্দ করে সে, কারণ অতুনুর প্রতি তার অশেষ কৃতজ্ঞতাবোধ।এতক্ষণ যার কথা ভাবছিলো সেই কল করে; আপনমনেই বলে উঠে সে, অতুনু ভাই অনেকদিন বাঁচবেন।
হ্যাঁ, অতুনু ভাই?”
নাফিস ভাই, আমি একটা জরুরী কাজে আটকা পড়ে গেছি; তাই আমার একটু দেরী হতে পারে”
আচ্ছা সমস্যা নেই ভাই... ডাক্তার বি...” কথাটা শেষ করতে পারলো না নাফিস, অতুনু বলল, “আচ্ছা এখন উনার কি অবস্থা?”
অবস্থা বেশি ভালো না ভাই”
কেন কি হইছে?”
আসলে ভাই, আম্মু কয়েকদিন ধরে চোখে একেবারেই দেখেন না, চোখের ডাক্তার তো কিছুই বুঝতে পারছেন না, আর এদিকে ডাক্তার বলেন, অন্য কিডনীটাও কয়েকদিনের মাঝে নাকি পুরাপুরি শেষ হয়ে যাবে ভাই”।
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে নাফিসের কেমন যেন গলা ধরে এসেছিলো, নাফিসের কথা শুনে অতুনুর বুকের ভেতরও কেমন এক শীতল অনুভূতি বয়ে যায়। চোখের কোণায় কিঞ্চিৎ পানি জমা হয়, “নাফিস ভাই আপনি কোন চিন্তা করবেন না, উপর ওয়ালা আছেন, উনি দেখছেন সব। কিছুনা কিছু ব্যবস্থা হবেই। দেখবেন সব কেমন যেন সুন্দর হয়ে যাচ্ছে আগের মতন।”
অতুনুর কথা শুনে নাফিসের মন যেন একটু শক্তি পেল। তখন পেছন থেকে কেউ ডাকলো, কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই বুঝে গেল এটা তার বোন সুপ্তি। কানে এলো একটি বাক্য, “ভাইয়া নাস্তা করতে চল”
নাফিস পেছনে ফেরার আগেই অতুনুকে বলে, “আচ্ছা ভাই এখন রাখছি দোয়া করবেন”
অকে। আল্লাহ হাফেজ”।
ফোন রখে দিল নাফিস।
সুপ্তির দিকে তাকিয়ে হাল্কা হাসি দিলো সে কিন্তু তার বোন সে হাসির কোন জবাব না দিয়ে বলল, “মামা অপেক্ষা করছে, চলো”
মনে মনে ভাবছে নাফিস আমি আমার মাকে বাঁচাতে পারব তো? আমার মা ভালো হয়ে যাবে তো? আল্লাহ, আমার মায়ের সাথে আমার এত কিছুর মিল দিলে, ব্লাড গ্রুপটায় কেন অমিল রাখলে? বুক ফেটে কান্না আসতে চায় তার।

তিন
পাঞ্জাবী গায়ে পড়ে নেয় অতুনু, যদিও তার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু তার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। হাল্কা সুগন্ধি মেখে বেরিয়ে পড়ল সে, দশটা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছে যায় আরশিতার প্রিয় রেস্টুরেন্ট বারফিতে। রিকসা করে আসার সময় দেখতে পেয়েছিল, রাস্তায় লাল সাদা আর নানান রঙের সমারোহ, লাল-সাদা শাড়ীর রমনীরা হেঁটে যাচ্ছে দল বেঁধে; স্কুল কলেজের মেয়েদের দেখল শাড়ীতে; কেউ লাল সাদা জামায়। কোন কোন ছেলেদের দেখল, লুঙ্গি আর মাথায় গামছা বেঁধে জটলা বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছে, কারো কারো হাতে বাঁশি, একতারা। বুঝতে পেরেছে সে, এদের গন্তব্য শিল্পকলা অ্যাকাডেমি। স্কুলে থাকতে সেও এমন গিয়েছিলো। এদের দেখতে দেখতে মনে হল, আচ্ছা আরশিতা কি আজ শাড়ী পড়ে এসেছে?
দরজা ঠেলে ভেতরের দিকে আগাচ্ছে, তার বুকের মধ্যে ধিড়িম ধিড়িম হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। চারদিকে ভালো করে তাকাতেই আরশিতাকে খুঁজে পেল সে। আরশিতা ভেতরে এসির সামনের টেবিলটায় বসে আছে নিরবে।
অতুনু এগিয়ে যায় টেবিলের সামনে। সামান্য আগে এসেছে বোধহয়, যার কারণে এসির নিচে বসেও কপালের ঘাম মুছতে ব্যস্ত আরশিতা; অতুনু বুঝতে পারলো অল্পতেই ঘেমে নেয়ে একাকার হওয়া মেয়েটির জন্য আজকে একটু বেশিই গরম পড়ছে। তাকে দেখে মুচকি হেসে বলে, “বসো” । আরশিতার হাসিটা তার ভেতরটায় একেবারে অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দিল যেন। তার দিকে তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারলো না অতুনু। সবুজ শাড়ীতে একেবারে অপূর্ব লাগছে তাকে। কপালে লালটিপ। চোখে কাজল আর চুলগুলো সুন্দর করে একপাশে করা। কপালের উপর দিয়েও কিচু চুল নেমে গেছে। আজ তার চেহারায় অন্যরকম স্নিগ্ধতা ভর করেছে। বারফির মৃদু আলোয় সেই স্নিগ্ধতা এক ঘোর লাগা আবহের সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ তুড়ি বাজানোর শব্দে ঘোরভাঙ্গে তার; আরশিতা বলে, “কি দেখছো?”
তোমাকে আজ অনেক অনেক অপূর্ব লাগছে!”
সত্যি??”
হ্যাঁ, আচ্ছা বলো কি ভাবলে?”
জানিস, আমার বিষন্ন আকাশ রাঙ্গাতে আমার যে কেবল তোকেই যে চাই”
প্রায় তিনদিন পর “তুই” শব্দটা শোনার পরও অতুনু যা বোঝার বুঝে নিল।
***
হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নাফিস আর সুপ্তি। সুপ্তি কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে। ঘুরতে গিয়েছিল বাইরে, ওর যাওয়ার ইচ্ছা কোনভাবেই ছিল না। ওর বন্ধুদের জোরাজোরি করায় ও আর মানা করতে পারেনি।
বেলা ক্রমাগত বেড়েই চলছে, সাথে নাফিসের অদ্ভুত দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। আজকে এখন পর্যন্ত অতুনু ভাই কোন খবর নিলেন না- আসবেন কখন বলছেন না, আচ্ছা শেষ পর্যন্ত অতুনু ভাই যদি মানা করে দেন? সাথে সাথেই এ চিন্তা বাতিল করে দেয় সে, এটা বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না তার মনের। কারণ, প্রায়- তিনি চার মাস আগে, মা’কে রক্ত দেয়ার তিনমাসের মাথায় আবার ফোন করতেই অতুনুভাই রক্ত দিয়েছিলেন এরপরে তদের বাড়িতেও গিয়েছিল। ঐদিন আমাদের সাথে খাওয়া দাওয়াও করেছেন, কত কথাবার্তা হয়েছিল, দুঃখী বাড়িতে কথা জমছিল না দেখে তাকে নিয়ে যায় খালের পাড়ে। অদ্ভুত কারণে তিনি মায়ের ব্যাপারে সবকিছু জানতে চান, এরপরে আশ্বস্ত করেন যে , রক্ত নিয়ে কোন সমস্যাই হবে না। রক্ত দেয়ার জন্য সর্বদা প্রস্তুত আছেন।
ভাইয়া অতুনু ভাইকে কল করে দেখ না” সুপ্তি বলে, “হূ” আলতো করে মাথা নাড়ায় নাফিস।
সুপ্তির বার বার মনে হচ্ছে তার মা আজ মারা যাবে। কেউ চাইলেও তাঁকে বাঁচাতে পারবে না। হয়ত সময়মত রক্ত পাওয়া যাবে, তারপরেও কেন যেন ভয় হচ্ছে; আর ভয়টা বাড়ছে, বাড়ছেই। বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিলোও কয়েকবার। তার এরকম মনে হওয়ার কথা কাউকে বলে নি সে, কারণ এতে বাকীরাও ভেঙ্গে পড়বে। আজকের দিনটায় হাসপাতালের তৃতীয় তলা পুরো ভুতুড়ে হয়ে আছে। প্রধাণ প্রধাণ ডাক্তার সহ অনেকেই আজকের দিনে অর্ধবেলার ছুটি নিয়েছিল, সন্ধ্যা হতে শুরু করলে অনেকেই ফিরবে। একটু আগেও ডাক্তার সুশান্ত সিং হাসপাতাল ত্যাগ করেন, যাওয়ার আগে নাফিস ভাইয়ের মা’কে পুনরায় চেক করে যান।
কি বলছেন” নাফিসের আতঙ্কগ্রস্থ গলা শুনতে পেল সুপ্তি। ভাইয়ের দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে যায় সে। নাফিসের চেহারায় স্পষ্টত আতঙ্ক আর হতাশার কালো ছায়া ভর করেছে।
সুপ্তি আমি একটু আসছি, কোথাও যাইস না, মায়ের কাছেই থাকিস প্লিজ”
ভাইয়া...” সুপ্তি কথা শেষ করার আগেই নাফিস সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে, সুপ্তির মনের ভয় আরো বেড়ে যাচ্ছে দোয়া পড়তে শুরু করে সে।

চার
গোমতী নদীর তীরে হাঁটছে অতুনু-আরশিতা। আরশিতা তার আঙ্গুলগুলোর ছোঁয়া অতুনুর আঙ্গুলে লাগিয়ে মজা করতে চাইছিলো কিন্তু অতুনু যেন খেয়ালই করলো না ব্যাপারটা। আরশিতা অতুনুর দিকে তাকালো ভালো করে। সে দেখতে পেল অতুনু ডুবন্ত রক্তিম সূর্যের দিকে একমনে কেমন বিষণ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে।
আরশিতা বলল, “কি হয়েছে রে?”
রিটার্ণ লাভ ইয়্যু বললেও, আরশিতা তাকে বলে সে তুই-তুমিতে আপডাউন করবে, আর খবরদারিও দেয় যে , এই নিয়ম কেবলই আরশিতার নিজের, তার একান্তই একার।
আরশু, আসলে আমার ফিরতে হবে”
কেন? এই তুই কি ঘরে বিয়ে করে বউ রাইখা আসছিস??” রাগ দেখিয়ে বলে ফেলে আরশিতা।
আরে না... আসলে হয়েছে কি...” । অতুনু আরশিতাকে সব বলতেই আরশিতা রাগে ফেটে পড়ে, বলে, “তুমি আমাকে আরো আগে বলতে! তুমি আসলেই একটা ...” বাকিটা অতুনুর ঢোক গিলা দেখে আর বলল না আরশিতা।
গোমতীর তীর থেকে এসে উঠল রাস্তায়। রিকসা নিয়ে নেয়, গন্তব্য সঞ্চরণের অফিস, যেখানে সে রক্ত দিয়ে আসে প্রতিবার। সেখানেই দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে, ওখানে পৌঁছেই কল করবে নাফিস ভাইকে।
রিকসা শিল্পকলার এদিকে আসতেই জ্যামে আটকা পড়েছে। সামান্য আগে শেষ হয় শিল্পকলার প্রতি নববর্ষের নিয়মিত আয়োজন । যেখানে অংশগ্রহণ করে নানান স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সবাই একযোগে বের হওয়ার দরুণ জ্যাম লেগে যায়। রিকসা থামিয়ে পার্কের দিকে হাঁটা ধরল তারা। পার্ক পার হয়ে কান্দিরপাড় মোড়ের ওদিকে যেতে হবে তাদের।
পার্কে এই বিকেল বেলায়ও প্রচুর মানুষ। পার্কের লেকের পাড়ে, ছেলেরা বড় বড় সাউন্ড বক্সের স্টল বসিয়ে গান বাজাচ্ছে আর উন্মাদের মত নাচছে, যাদের মধ্যে উঠতি কিশোর আর যুবক বিদ্যমান। প্রতি স্টলে এদের সংখ্যা অনেক যার কারণে মানুষদের হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। নাচের একটি দলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অতুনুর গায়ের সাথে ধাক্কা লাগে একটি ছেলের। ছেলেটি ভাঙ জাতীয় কিছু খেয়েছিলো যার কারণে, তার তাল ঠিক ছিল না, অতুনুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। অতুনু এড়িয়ে যেতে চাইলে, ঐ ছেলেরই আরেক সহযোগী আরশিতার দিকে বাজে ইঙ্গিত করে বসে, গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা চালায় আর কিছু অশ্লীল কথা বলে বসে অতুনু আর আরশিতার নামে। আরশিতা থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার খুবই বাজে লাগছে, সে চাচ্ছিলো এখনই দৌড়ে পালিয়ে যায় স্থানটা থেকে। অতুনু আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি, বসিয়ে দেয় ঐ ছেলেটির গালে কষিয়ে এক থাপ্পড়। আরও মারতে যাচ্ছিলো, অতুনুকে বাধা দেয় আরশিতা।
থাপ্পড় খাওয়া ছেলেটি কয়েকমুহূর্ত নিজের চোখেমুখে অন্ধকার দেখেছিলো।ভাবছে, এত জোরে থাপ্পড় তার বাপেও তারে দেয়ার সাহস করেনি; আর কোথাকার কোন এই ছেলে মেরে... (অশ্রাব্য ভাষায় গালি) । ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে যায় তার স্টলের পেছনে। তার প্রিয় জিনিসটা তুলে নেয়। মুচকি হাসে। দৌড়ায় সেদিকে, যেদিকে আরশিতা আর অতুনু গেছে। গান এখনও বাজছে, এখনও নাচছে ওরা। ছেলেটির গন্তব্যবের ওদের কারো দিকে খেয়াল নেই। একদিনের জন্য আজ সবাই অন্য জগতে।
ছেলেটাকে থাপ্পড় মারার পর তারা আবার হাঁটতে শুরু করে, কিছুদূর আসার পর পরই সাউন্ড বক্সগুলোর গানের আওয়াজ ছাপিয়ে একটি মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পেল চারদিকের মানুষ। আরশিতার সামনেই মাটিতে লুটিয়ে রক্তাক্ত অতুনু। ঘাতক এর মাঝেই দৌড় দিলো, মানুষ এসে জটলা পাকায়। কয়েক মুহূর্তে পুলিশও এসে হাজির। রক্তাক্ত অতুনু কোঁকড়াচ্ছে, আরশিতা মাটিতে বসে নিজের কোলে তুলে নেয় অতুনুকে। অতুনুর ক্ষতস্থানে তাকিয়ে আঁৎকে উঠেআরশিতা, পেটের মাঝ বরারর ছুরি চালিয়েছে ঘাতক। ক্ষত থেকে গলগল করে রক্তে ভেসে যাচ্ছে সব।গান আর শোরগোল চলতেই থাকে। আরশিতার কাছে কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা এগিয়ে আসে তার দিকে। পার্কের কাছাকাছি অবস্থিত মুন হসপিটালে নিয়ে যায় তাদের। সেখানে গিয়ে দেখা গেল কোন ডাক্তার নেই , অতুনুকে জরুরী বিভাগে নিয়ে যাওয়া হল। ওয়ার্ডবয়রা খোঁজ নিয়ে জেনে নিচ্ছেন ডাক্তারদের অবস্থান। একজন ডাক্তার হাবিবুল বাশারকে পাওয়া গেল। উনি আসেন। বলেন, সিরিয়াস ইঞ্জুরির কেস; একা উনার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব না। তাই উনি টাওয়ার হসপিটাল এর ডাক্তার সুশান্ত সিং-কে ডেকে নিয়ে আসেন, ডাক্তার আসার কিছুক্ষণ পরেই অতুনুর মোবাইলে কল আসে, মোবাইল টা ছিল আরশিতার কাছে। সে কল রিসিভ করে। কল করেছিলো নাফিস ভাই।
***
অতুনুর মোবাইলে কল করে একটা মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পেয়েই ভড়কে গিয়েছিল নাফিস। সে নারী কন্ঠটার কাছে শুনতে পায় যে, অতুনু এখন হাসপাতালে। নিজেকে থামাতে পারলো না, মুন হসপিটালের জন্য দৌড় দেয়। ইমার্জেন্সি রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে, তার মায়ের একমাত্র ডোনার এখন নিজেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে, নাফিসের উচিৎ তার মায়ের জন্য আরেকটি ডোনার জোগাড় করা, কিন্তু সে করছে না। এখন তার মায়ের চেয়ে অতুনুর জন্যই বেশি খারাপ লাগছে , হাসিখুশি থাকা ছেলেটার এমন দিন আসবে সে কখনও ভাবেনিও।
অপারেশন থিয়েটারর থেকে বের ডাক্তার হাবিবুল বাশার অতুনুর বড় ভাই অপু আর আরশিতাকে বললেন, “মাই গড! উনার শরীর থেকে অনেক ব্লাড চলে গেছে, এখন দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। রক্ত ছাড়া কোনভাবেই বাঁচানো সম্ভব না, এর উপরে উনার ব্লাড ও নেগেটিভ। কি যে মুশকিল!! আপনারা খোঁজ নিতে থাকেন; আমিও দেখি”।
ডাক্তারের এ কথা শুনে নাফিস ভাইয়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। নাফিসের চোখে হঠাৎ কেন যেন হাসপাতালের ঐদিনের ঘটনা চোখে আসলো, যখন নাফিসের নিজের মা’কে অতুনুও মা ডাকে। আজকে সকালেই যে অতুনু ভাই বলেছিলো, “নাফিস ভাই, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। উপরওয়ালা আছেন, উনি দেখছেন সব। কোন না কোন ব্যবস্থা উনিই করে দিবেন”। কোন না কোন ব্যবস্থার কথা মনে পড়তেই নাফিস সঞ্চরণে কল করে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করে। সুপ্তিকেও বলে দেয়। সুপ্তি তার ফেসবুক প্রোপাইলে রক্ত নিয়ে পোস্ট করে।
আরশিতার কোনরুপ প্রতিক্রিয়া হল না, আরশিতা ডাক্তারকে কি যেন বলে। ডাক্তার বলেন, “ও মাই গড! এ কি বলছেন আপনি?? আপনি শিওর তো, নাকি??” এই কথা বলে, ডাক্তার সাহেব তাকালেন অতুনুর বড় ভাই অপুর দিকে। উনি কিছু বললেন না, মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আরশিতা বলে, “হ্যাঁ আমি শিওর আপনি জলদি করুন”। ডাক্তার হাবিবুল বাশার হনহন করে ছুটে গেলেন অপারেশন থিয়েটারের দিকে।
অপুর ছেলে মেয়েরা তাদের বাবাকে বার বার জিজ্ঞেস করছে, “বাবা, বাবা, অতুনু চাচ্চুর কি হয়েছে?”
আরশিতা একজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “এইতো চাঁদের দেশে। তারাদের সাথে দেখা করতে”।
এগিয়ে যায় নাফিসের দিকে, “নাফিস ভাই- রক্তের জন্য বৃথা চেষ্টা করবেন না প্লিজ, জানি অতুনুকে বাঁচানো আমাদের কারো পক্ষে আর সম্ভব না”।
নাফিস জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় আরশিতার দিকে।
অতুনুকে স্ট্রেচার এ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, নাফিস তাকিয়ে রইল সেদিকে। মুখের উপর চাদর নেই, সেই মুখে আতঙ্কের ছাপও নেই।

পাঁচ
সূর্যের দিকে একমনে তাকিয়ে থাকা মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছিলো সে তার মায়ের চলে যাওয়া। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো আরশিতাকে যে, চলো ফিরে যাই আজকে অনেক ঘুরা হলো আমাদের, আমার যে খুবই জরুরী এক কাজ পড়ে আছে। আরশিতা পরে ঠিকই ব্যাপারটা ধরতে পারে, বকে খুব।
রিকসায় উঠার পর যখন তা চলা শুরু করে, কানে বাজে ক্রিং ক্রিং সাইকেলের আওয়াজ, রিকসা উলটে যাওয়ার শব্দ, মায়ের মাথার একপাশ ফেটে রক্ত পড়ার দৃশ্য; চোখে আসলো পর পর, অতুনু যখন কোনমতে উঠে দাঁড়ায়, তার মা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফুটপাতে ঠেলে দেয়ার দৃশ্য আর সিনএনজি এসে তার বদলে তার মাকে ধাক্কা মারার আরেকটি দৃশ্য।
সে আবার এ দৃশ্যগুলো মনে করতে চাচ্ছে না, মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে তার। বারো বছর বয়সী ছেলে অতুনু দেখছে, তার মায়ের রক্তের প্রয়োজন- বাবা সময়মত যোগাড় করতে পারেনি; তার মায়ের আর বেঁচে থাকা হলো না। মায়ের জন্য আজ বেঁচে অতুনু। বড় হয়ে একদিন যখন জানতে পারলো তার মায়ের আর তার রক্তের গ্রুপ এক, সে নিজেকে কোনভাবেই শান্তনা দিতে পারছিলো না, সে কেন ছোট ছিলো? সে কেন রক্ত দিয়ে তার মা’কে বাঁচাতে পারলো না?
ভাই, এখানে তো জ্যাম লাগছে, ছুটতে তো অনেকক্ষণ” রিকসাওয়ালার কথায় বাস্তবে ফিরে সে। তারা নেমে যায়।
অতুনু ভাবছে, তার মায়ের মতই কি রক্তের অভাবে মারা যাবে নাফিস ভাইয়ের মা?? যার মাঝে নিজের মা’কে খুঁজে পেয়েছিলো অতুনু? সে কি তার আরেক মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে?
হাঁটার গতি বাড়ায় সে। এতেই বিধিবাম; ধাক্কা লাগে কার সাথে যেন। সে এড়িয়ে চলে আসতে চাইলো, আরশিতাকে বাজে বলায়, হঠাৎ তার মায়ের কন্ঠতার কানে বাজে, “তোর বান্ধবীকে বাজে বকছে আর তুই চেয়ে আছিস?”
কষিয়ে এক থাপ্পড় মারে ছেলেটিকে। এবার গতি বাড়ায় হাঁটার।
আবার তার আগের ভাবনা জেগে উঠে, এমতাবস্থায়। পেটে শীতল কিছু ডুকে যায়, কয়েকবার। খুব জোরে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে সে। চারদিক কেমন যেন ঘোলা লাগছে তার। পেটের তরল হাত দিয়ে দেখে রক্ত! তার খুব কষ্ট লাগছে, সে সময়মত নাফিস ভাইয়ের মায়ের জন্য পৌঁছাতে পারলো না। হঠাৎ নাফিস ভাইয়ের কথাটা তার কানে আসলো, “জানেন অতুনু ভাই, আমার আম্মার আর আমার ব্লাড যদি ম্যাচ হত। আম্মাকে আর এত কষ্ট করতে হতো না, সেই কবেই আম্মাকে নিজের একটা কিডনী দিয়ে দিতাম। আম্মাকে এভাবে দেখে কষ্ট লাগে খুব”।
আরশু..” কোনমতে ডাকলো সে।
আরশিতার নিজের কোলে অতুনুর মাথাটা উঠায়, “অতুনু চুপ, চিন্তা করিস না এক্ষণই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি তোকে!”
আরে আমার একটা ক...ক...থা রাখবি?”
বল...”
আমি জানি আমি বাঁচবো নারে...”
বেদ্দপ, চুপ কর প্লিজ!” কেঁদে দেয় আরশিতা।
আমি মরে গেলে, তুই প্লিজ আমার কিডনি নাফিস ভাইয়ের মা’কে দিস!”
তুই বাঁচবি, তোর কিচ্ছু হবে না!”
মা’কে কিডনীগুলা দিস রে...”
তার মাথা ভারী হয়ে আসছে, চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার দেহ কিছুটা নড়ে, কিন্তু তার কষ্ট হয় না। তার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি লেগে থাকে।
***
রাত দশটা।
অপারেশন থিয়েটারের সামনে একটি বিশাল জটলা। অতুনুর ভাইয়া-ভাবী, ভাতিজা, ভাতিজি, আরশিতা; নাফিসের ছোট ভাই, মামা, সুপ্তি এবং চৌদ্দগ্রাম থেকে আসা আরেকজন ডোনার, মিনহাজুল। সুপ্তির পোস্ট পেয়েই যে ছুটে আসে।
সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।ডাক্তার সুশান্ত সিং আর হাবিবুল বাশার বের হলেন একসাথে, মুখের মাস্ক খুলে বললেন- কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশন সাকসেসফুল। দুটো কিডনীই ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে।

                             ((... সমাপ্ত ...))
উৎসর্গঃ সুনামিকে ( Nowrin )
আমি সবসময়ই নাম নিয়ে বিভ্রান্ত থাকি। এই গল্পে “অতুনু” আর “আরশিতা” এ দুটো নামই তার থেকে নেয়া। সত্যি বলতে, অতুনু আর আরশিতা নামটা আমার এতই পছন্দ হয়েছিল যে, আমার মন ছটফট করছিলো কখন শেষ করব গল্পটা।

গল্পটার পেছনের গল্পঃ
এই প্লটটা প্রথম মাথায় আসে আমার ৪ই এপ্রিল, ২০১৬। আমি এই পর্যন্ত তিনবার রক্ত দিয়েছি। এরমধ্যে দুইবারই দিয়েছি, রাজু নামক এক ভাইয়ের মা’কে। ঐদিন সকালে রক্ত দিতে যাওয়ার সময়; আমার মাথায় বার বার আসছিলো আমি যদি সঞ্চরণ গিয়ে না পৌঁছাই? আর আমি যদি রক্ত না দিতে পারি? তাছাড়া রাজু ভাই আমাকে বলেছিলেন যে, ঐদিনই নাকি শেষদিন। এর আগেও একবার চেয়েছিলেন, মাস খানেক আগে, তখন আমি অসুস্থ থাকার কারণে আর দিতে পারি নাই। তাই এবার নিশ্চিত ছিলাম দিবোই। এই ভাবনা থেকে মাথায় আসে। “ও নেগেটিভ” নামের এই প্লট। ই ও নেগেটিভ নিয়েই ভাবতে থাকি।

১৪ই এপ্রিল, নববর্ষের দিন। Mozammel আর Mahfujul আমরা পার্কে ছিলাম, মহিলা মহাবিদ্যালয়ের এদিকে ছিলাম কুমিল্লা সাংস্কৃতিক সংঘের অনুষ্ঠান চলে, এমন সময় দেখি- পুলিশ সহ, মানুষের হুড়োহুড়ি। পরে জানতে পারি; সাধারণ কথার জের ধরে। একজন কলেজ পড়ুয়া, আরেকজন মানুষকে ছুরিকাঘাত করে, যার ফলে ভিক্টিম মারা যায় কিনা, জানতে পারিনি। এরপর এটা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে বার বার প্রতিবার।
যখন ও নেগেটিভ নিয়া ভাবতে থাকি। বার বার, তখন এটাও এসে যুক্ত হয়। এরপর দুটোকে এক সাথে মিলিয়ে “এই নববর্ষ অন্য কথা বলে” এর রুপ দেই।  পরীক্ষার জন্য গল্পটা তখন শেষ করতে পারিনি, যদিও এক দু পৃষ্ঠা লিখেছিলাম মাঝে মাঝে।

এই গল্পে, অতুনু এর মধ্যে আমি দোটানায় পড়লে যেরকম বিক্ষিপ্ত ভাবে ভাবি; চিন্তা করি- তা তুলে ধরেছি।
নাফিস ভাই আর উনার মা, রাজু ভাই আর উনার মায়ের প্রতিচ্ছবি।

বিঃদ্রঃ আমার পাশে ঘটা সত্য ঘটনার কিছুটা এখানে আনলেও, ঐ ঘটনার পুরোটা নেই কিন্তু।।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ