গল্প | একজন বাবার জন্যে



একজন বাবার জন্যে

।।এক।।
"একদম সঠিক উত্তর, এবং সেই সাথে আপনি জিতে নিলেন পুরো দশ কোটি টাকা। অভিনন্দন নোমান সাহেব, অনেক অনেক অভিনন্দন আপনাকে।" একরকম বিজয়োল্লাসের সাথে বললেন তিনি।
কথাটি বলার সাথে সাথে জোরে সাউন্ডসিস্টেম বেজে উঠে, আর আমাকে এবং উনাকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট রঙ্গিন কাগজ উড়তে থাকে।
আমার সামনে যিনি উনার নাম আসাদুজ্জামান নূর।অনেক বড় এক অভিনেতা এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ।আমার সামনে একটি মনিটর যেখানে বড় বড় করে লেখা Congratulations Mr. MD Noman Bhuiyan। আমাদের ঘিরে বসেছিলেন অসংখ্য নর-নারী যারা এতক্ষণে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন আর আমার জন্য হাততালি বাজাচ্ছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম নূর সাহেবও দাঁড়িয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। ঘোর লাগা চোখে চারদিকে চোখ বুলাচ্ছি। ঝাপসা হতে থাকে যেন হঠাৎ করে আমার চোখ জোড়া।চারদিকের শব্দে আমার কানে তালা লাগার উপক্রম। নিজের ভিতরে আনন্দ আর বিস্ময়ের ফোয়ারা ফুটছে। জানি না, কোনটা আমার চেহারায় বেশি ফুটে উঠেছে।
ভিড়ের মাঝে একজনের সাথে চোখাচোখি হতেই আমার দৃষ্টি আটকে গেল তার উপর। মায়াবতী। সে আমার সাথেই এখানে এসেছে। নূর সাহেব আমাকে ডাকছেন, "নোমান সাহেব, নোমান সাহেব...!"
ঘোর লাগা মুহূর্ত থেকে ফিরে আসতে দু সেকেন্ড সময় নিলাম। প্রায় চিৎকার করে বললাম, "আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক" টাকাটা নিজের হওয়াতে যত খুশি আমি মূলত অন্য কারণে অনেক উৎফুল্ল হয়ে আছি এখন।
শুধরে দিয়ে বললেন নূর সাহেব,  "কয়েক কোটি না নোমান সাহেব, আপনি এখন পুরো ১০ কোটি টাকার মালিক!"
আবার শুরু হল কানে তালা দেয়া করতালি।
ঘোর লাগা শুরু হতেই  কানে বাজতে শুরু করল একটা নারীকন্ঠ, "তুই অনেক বড় হবি খোকা।" ছোটবেলায় ফিরে গেলাম দুসেকেন্ডের জন্য।রেবা বুইজা মাথায় হাত রাখলেন।প্রচ্ছন্ন, স্বচ্ছ এক হাসি দিলেন। বললেন, "তুই অনেক বড় হবি খোকা!"
মায়াবতীর দিকে তাকাতেই সেও প্রচ্ছন্ন এক হাসি দিল। আমার মনের জোর যা কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়। আমার মনে আছে,  আমার এতদূর আসার প্রতিমুহূর্তের  সঙ্গী সে।
আমাকে সে-ই বলে "কে হতে চায় কোটিপতি " টিভি রিয়েলিটি শো এর কথা।এবং যখন ৫ কোটি টাকার প্রশ্নে আটকে গেলাম, প্রশ্নের ভুল উত্তরে পেতাম কেবল ৫০ লাখ- যদিও আমার প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট ছিল; তখন লাইফলাইনে সে সাহায্য করেছিলো আমাকে।
জানিনা এটা কাকতাল কিনা, ঐ প্রশ্নের উত্তর তখন তার জানা ছিল।
"তো নোমান সাহেব আপনি এ খবর কাকে প্রথমে জানাতে চান?" নূর সাহেব ততক্ষণে বসে পড়েছেন নিজের উষ্ণ আসনে তথা হটসিটে। গভীর আগ্রহে তিনি চেয়ে আছেন আমার দিকে। উপস্থিত সকলের দৃষ্টিও আমার দিকে বন্দি।
ঠিক এইখানে এসে আমি একেবারে দ্বিধায় পড়ে  গেলাম।কিন্তু কেন, আমার কি কল করার কেউই নেই? নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম।কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না নিজের কাছ থেকে।
"তুই অনেক বড় হবি রে খোকা" যার কথা সবসময় কানে বাজে, তাকে জানাব? যে দশটাকা চেয়েছিলো বলে পুরো একশ টাকা ধরিয়ে দিয়েছিলাম হাতে। যাকে এরপর আর দেখিনি কখনও। কারণ, সেবার গ্রাম ছেড়ে চলে আসলে, পরের বারে গ্রামে গিয়ে রাবু বুইজাকে খুঁজে পাইনি। রাবু বুইজা- যিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, "তোর মন এতবড়, কারমত  জানিস? ঠিক তোর দাদার মতো।"
যদি না ফেরার দেশে ফোন করা যেত,  আমি তাহলে তাকেই প্রথম কলটা করে জানাতাম খবরটা।একবার ভাবলাম নূর সাহেবকে জিজ্ঞেস করব, না ফেরার দেশে কল করা যায় কিনা। কিন্তু পর মুহূর্তেই সেটা বাদ দিলাম।আমি দশ কোটি টাকার মালিক, উদ্ভ্রান্তের মত প্রশ্ন করলে চলবে না।
আমি বললাম, "সাবের সাহেবকে ফোন করুন, এই নিন নাম্বার।"
মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট থেকে "Saber Uncle" নামক কন্টাক্ট টা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। তাদের কাছে পারিবারিক কিংবা যাদের যাদের ফোন করতে পারি তাদের নাম্বার জমা দেয়ার সময় সাবের রহমানের টা কেন যেন বাদ পড়ে গিয়েছিল।
মায়াবতী তো আমার সামনেই। আর বাবা মা তাদেরও আমার সাফল্যের এ খবর টি পৌঁছে দিতে পারি। আমার মনে হয় তাদের জানানোর কিছু নেই, কারণ তারা টিভির সামনে বসে আমাকে দেখছেন।
আমার মনে রাবু বুইজার সাথে সাথে চলছিল সাবের রহমানের কথা। যার জন্যে কিছু করার মানসিকতা আমাকে এতদূর আসার প্রেরণা জুগিয়েছে।
নূর সাহেব আমার কথামত নাম্বারটিতে কল করলেন। রিং হচ্ছে , এই ফাঁকে জানতে চাইলেন, "সাবের আঙ্কেল - কে উনি?"
আমি বললাম, "একজন বাবা, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন মৃত্যুপথযাত্রী"
বুঝতে পারলাম চোখের কোণা হঠাৎই ভিজে গেল।
আচ্ছা সাবের সাহেবের বাসায় কি টিভি আছে?তিনি কি দেখতে পাচ্ছেন আমাকে? আজ দেশের কোটি কোটি মানুষের সামনে এক জ্বলন্ত বিস্ময় আমি। আমি কি তার চোখে বিস্ময় সৃষ্টি করতে পেরেছি? বহুদিন ধরে অকেজো পড়ে থাকায় হয়ত বিক্রি করে দিয়েছেন টিভিটা। নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে টিভি/ফ্রিজ থাকতে নেই?
নূর সাহেব আরো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই, তাদের পাশের বড় স্ক্রিনে দেখা গেল রিং হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ও পাশ থেকে কেউ একজন কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, "হ্যালো"
"হ্যালো, জনাব সাবের রহমান বলছেন?"
"জ্বি, আপনি কে?"
"আমি আসাদুজ্জামান নূর বলছি,'কে হতে চায় কোটিপতি' অনুষ্ঠান থেকে, আপনার সাথে মোঃ নোমান ভূঁইয়া কথা বলতে চাচ্ছেন, উনি আজকের ১০ কোটির টাকার বিজেতা।"
নূর সাহেব ইশারা করতেই আমি বলা শুরু করে দেই," হ্যালো চাচা আমি নোমান। চিনতে পেরেছেন?"
"হ্যাঁ বাবা"
"রিমি আপুকে বলুন চিন্তা না করতে । ওর এই ছোট ভাই সব ঠিক করে দেবে।"
কিছুক্ষণের জন্য যেন ওপাশ পুরো থমথমে হয়ে গেল।হঠাৎ বিকট শব্দ। আমি বললাম, "হ্যালো হ্যালো...."
কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই। লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। জানিনা, মুক্তিযোদ্ধা চাচার কাছে ব্যাপারটা কেমন লেগেছে...আচ্ছা উনার আত্মসম্মানে লাগেনি তো??
।।দুই।।
সাবের রহমানের ঝুপড়ি থেকে হাল্কা আলোর ঝলকানি আসছে।  সে আলোর পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে আরিফ।তার মেজাজ আজ বেশ গরম।কোমরে গুঁজে রাখা ধাতব বস্তুটির উপস্থিতি নিশ্চিত করে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে।
আজ সাবেরের একদিন কি তার একদিন। রিমির এত্ত বড় সাহস তাকে থাপ্পড় মারে??
আরিফ তাদের এলাকার নব্য মাস্তান। স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডান হয়ে উঠেছে কয়েক মাসের ব্যবধানে। পুরো এরিয়ায় বলতে গেলে তারই রাজত্ব। সাবেরের মেয়ের পেছনে ছ মাস ধরে ঘুরছে। নানান ছলে মেয়েটার সাথে কথা বলতে যায়। আজ মেয়েটা ঘরের বাইরে বেরিয়েছিলো অনেকদিন পর। তাকে দেখেই আরিফ নানান কুৎসিত কথা শোনায়। এতেই ক্ষেপে যায় রিমি। রিমির আর মেডিকেলে যাওয়া হল না। অসুস্থতার দরুণ বাইরে বের হতে পারে না, যেই একদিন বের হতে গিয়েছে ওমনি...
আরিফের বিরুদ্ধে কেউ একটি কথা বিরুদ্ধে বলতে যায় না। আর সেখানেই রিমি তাকে থাপ্পড় মেরেছে? এত্তবড় অপমান!!
দিনে দলের কাজ থাকায় আসতে পারেনি। তাই এই রাতে তার আগমন।
জোরে জোরে দরজা ধাক্কায়। কেউ খোলে না। ভেতরে সাবের সাহেব আতঙ্কিত। তিনি মোবাইলে কথা বলছিলেন। অনিচ্ছাকৃতভাবে মোবাইল রেখে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।
দরজা খুলতেই সাবের সাহেবকে ধাক্কা মেরে ডুকে পড়ে আরিফ, "রিমি.... এই রিমি... "
"আরিফ.... তুই??!!" সাবের দেখতেই পারেন না আরিফকে। তুই তোকারি করে বলেন।
" হ আমি, তোর মাইয়ারে লইয়া যাইতে আইছি" আরিফ রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আছে।
"কি????" বলেই থাপ্পড় বসালেন সাবের সাহেব আরিফের গালে।
"কে কে...?" ভেতরের কামরা থেকে বেরিয়ে আসে রিমি। তার মাথা দুলছে। সবসময়ইই এরকম হয়, আতঙ্কিত হয়ে গেলে।
"মা তুই ভেতরে যা, তোর এই বাপ একাত্তরে যেরকম মা বোনের কিছু হতে দেয়নি। আজও তোর কিছু হবে না ভেতরে যা তুই।"
"না বাবা"
আরিফ সাবেরকে ধাক্কা দেয়, বেশ জোরেশোরেই। এতে তিনি পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান।বুকের দিকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। আরিফকে এগিয়ে যেতে দেখে রিমির দিকে তিনি যেন আবার তার একাত্তরকে ফিরে পান। দরজার পাশে থাকা একটা লাঠি নিয়ে সজোরে বারি মারতে গেলেন আরিফের মাথায়। আরিফ সরে যায়। এগিয়ে এসে নিজের কোমর থেকে ধাতব বস্তুটি বের করে। ছুরি। বেশ কয়েকবার চালান করে দেয় সাবেরের পেটে।
তা দেখে চিৎকার করে কান্নায় ফেটে পড়ে রিমি।কিন্তু রিমিরও নার্ভ নিস্তেজ হয়ে আসছে। বাবার কাছে আসার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। আরিফ তা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল। রিমির কাছে এগিয়ে যাচ্ছে এমন সময় বাইরে গাড়ির শব্দ শুনতে পেল সে।
পালাতে হবে।মুহূর্তেই বুঝে যায় আরিফ।
।।তিন।।
" নোমান সাহেব,  এই সাবের রহমান- মুক্তিযোদ্ধা, বাবা, মৃত্যু পথযাত্রী... কিছুই বুঝছি না। একটু বলুন। " নূর সাহেব জানতে চাইলেন।
আমি বলা শুরু করি, "সাবের আঙ্কেল উনাকে আমি চিনি উনার চায়ের দোকান থেকে। ওখানে বন্ধুবান্ধব সহ চা খেতাম, আড্ডা দিতাম। একবার উনি আমাদের ফ্রিতে চা খাওয়ান যখন আমি ইন্টারে সবে মাত্র উঠেছি। ঐদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। উনার মেয়ে রিমি আপু চান্স পেয়েছিলেন।
ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের পর আমি উনার আর খোঁজ নেইনি। উনার মেয়ে থেকে ইন্সপারেশন নিয়েই পড়ালেখা শুরু করি। একজন চা দোকানির মেয়ে পারলে আমি পারব না কেন? এ জিদে পড়তে শুরু করি।তখনও উনার পরিচয় জানতাম না আমি।
বুয়েটে চান্স পেয়ে গেলাম। চাচাকে খোঁজ দিব ভাবি, কিন্তু উনার দোকান আর ঘর তালাবন্ধ ছিল। জানতে পারি তারা হাসপাতালে।
আমি সেখানে পৌঁছে যাই। গিয়ে আমি আমার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। লোকটা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন। চাচার কাছে এগুতেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন, একেবারে কেঁদেই দেন। এ শহরে তার তেমন পরিচিত কেউ না থাকলেও আমার মত স্বল্প পরিচিত ছোকরার মাঝেও যেন চিরপরিচিত আত্মীয়ের খোঁজ পেলেন তিনি। আমি জানতে চাইলাম কি হয়েছে, উনি বলেন সবকিছু।
সাবের রহমান যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তখন তিনি ছিলেন ২০ বছরের জোয়ান। যুদ্ধের মধ্যে থেকে অনেকের মৃত্যু দেখলেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তিনি। বিয়ে করেছিলেন, পঁচাত্তরে কিংবা ছিয়াত্তরে।  এরপর অনেক বছর তিনি কোন সন্তানাদির দেখা পাননি। অবশেষে নব্বইয়ের দিকে তার কোল আলো করে এলো রিমি আপু। মেয়েটার জন্মের ক'দিন পরেই মেয়েটার মা মারা যায়। কারণ, মেয়ের মায়ের ইনফেকশন হলে চিকিৎসা করানোর টাকা ছিল না।জায়গা বিক্রি করার ব্যবস্থা করার আগেই পাড়ি জমান ওপাড়ে।
একমেয়ে আর নিজের নীরব পরিবার বেশ ভালোভাবেই চলছিল।মেয়ের বয়স পনের ছাড়িয়ে গেলে মেয়ের উপর নজর পড়ে গ্রামের চেয়ারম্যানের। যে হল নামমাত্র চেয়ারম্যান আদতে সে কুখ্যাত "রমিজ রাজাকার"
নিজের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে আসেন অজানা শহর ঢাকাতে।এখানে এসে একটু ঝুপড়িতে কোনমতে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছেন। চলেন ছোট একটা টঙ দোকান চালিয়ে। মেয়েকে বড় ডাক্তার বানাবেন তার খুব ইচ্ছা। তাই যত কষ্টই হোক মেয়েকে তিনি পড়াতে লাগলেন। মাঝে মাঝে অর্থকষ্টে পড়লে গ্রামের বাড়ি সম্পত্তি বন্ধক রেখে আসতেন। সেদিন মেয়ে হঠাৎ ক্লাসে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর,  কিছু টেস্ট করতে হয়। যেগুলোর টাকা যোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়েছিল তাকে।
এরপর তিনি একবার যান মেয়রের অফিসে। যেখানে নিজের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন তাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু দূরদূর করে তারা তাড়িয়ে দেয়...!!"
এতটুকু বলার পর আমি থামলাম। নূর সাহেবের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনার চোখে পানি। উপস্থিত জনতাও নীরব।আবার বলা শুরু করি, "নিজের দোকানের জায়গাটা বিক্রি করে দিয়ে, ফাইনাল টেস্ট করান। ডাক্তার বলেন, মেয়ের ব্রেন টিউমার হয়েছে, সেকেন্ড স্টেজে। মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বিদেশে অপারেশন করালে পুরাপুরি আরোগ্য লাভ সম্ভব।
একজন দেশরক্ষক হয়ে তার নিজের অবস্থা এরকম হবে তার কাছে এটা আশাতীত ব্যাপার।তিনি আক্ষেপের স্বরে বলেন, যদি আমি ওদের স্থানে হতাম। সত্যি কোন মুক্তিযোদ্ধার এ করুণ অবস্থা হতে দিতাম না।
পরে জানতে পারি সাবের সাহেব নিজেও হার্টের রুগী। তাকে বেশি স্ট্রেস এ রাখা যাবে না। নিজের মেয়ের চিন্তায় নিজেও এখন মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারেন যেকোন সময়।
এরপর আমি সেদিন থেকেই সিদ্ধান্ত নেই যে রিমি আপু সুস্থ হবেই। যেভাবেই হোক।
আর এখন আমি চাই, আমার টাকা দিয়ে রিমি আপুর চিকিৎসা করা হোক। আর সকল নির্যাতিত, নিপীড়িত দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ব্যয় করব রিমি আপুর চিকিৎসা বাবদ বাকী টাকা।
।।চার।।
আমার মুখ থেকে সব শুনে  নূর সাহেব নিজের চোখে আঙ্গুল চালিয়ে বললেন, "আপনার এ মহৎ উদ্যোগ কে আমরা সালাম জানাই।আপনাকে এখানে পেয়ে সত্যিই আমরা আনন্দিত।"
এরপরের টা আশা করিনি, উনি আবার দাঁড়ালেন, বলেলেন, "আরেকটাবার করতালি হয়ে যাক,নোমান সাহেবের জন্য।"
সবাই দাঁড়িয়ে গেল। কেউ কেউ চোখ মুছেছেন।
এরপর অপারেটর কে বলেন সাবের রহমান সাহেবকে আবার কল করার জন্য। কয়েকবার করছেন। কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না, দেখে আমরা সবাই অবাক হলাম।দর্শকেরাও বেশ আগ্রহভরে টিভির সামনে বসে আছেন নিশ্চয়ই।
আমি মনে মনে বিপদের তীব্র গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমি নূর সাহেবকে বললাম, "উনার কোন বিপদ হয়নি তো? আমি উনার সাথে এখনই দেখা করতে চাই! আমি উনার মেয়ের চিকিৎসার টাকা উনার হাতেই দিতে চাই, আর বলতে চাই এটাকে সহানুভূতি কিংবা নিছক দয়া যেন না ভাবেন।"
শেষের কথাগুলোয় আমার কন্ঠ ভারী হয়ে যায়। নূর সাহেব হয়ত বুঝতে পেরেছেন ব্যাপারটি।
আমরা সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ি, লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে মনে হয় আমাদের এই আজকের ভিন্ন যাত্রা।
রাত বাজে ৯ টা। এই সময়ে উনি আমাদের এত লোকবল দেখে আবার অবাক হবেন না তো???
আমরা সাবের সাহেবের ঝুপড়ির সামান্য সামনে এসে গাড়ি পার্ক করলাম। হঠাৎ মনে হলো, সাবের সাহেবের ঝুপড়ির ভেতর থেকে কেউ যেন পালিয়ে গেল। আমি ছুটে গেলাম সেদিকে।দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আমার ভেতরের আত্মা চিৎকার দিয়ে উঠে, "নূর সাহেব, অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন জলদি...!!"
মায়াবতীর চোখেও দৃশ্যটা পড়তে সেও সজোরে চিৎকার করলো। এতে আশেপাশের মানুষ আসতে শুরু করে।
সাবের সাহেব ঘরের একপাশে পড়ে আছেন রক্তাক্ত অবস্থায়।
আর উনার মেয়ে কিছু দূরে অজ্ঞান অবস্থায়। অতিরিক্ত শকে মেয়েটা সেন্স হারিয়ে ফেলে।
নূর সাহেব আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে, "অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিয়ে দিয়েছি। উনার এ অবস্থা কে করেছে??"
"হয়ত আরিফ...."
পরিশিষ্টঃ
২ দিন পার হয়ে গেল। এর মধ্যেই ঘটে গেল অনেক ঘটনা। সাবের সাহেবের বাসায় হামলার কারণে আরিফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।যথাযোগ্য শাস্তিই তার হবে।
আসাদুজ্জামান নূর সাহেব,  মিডিয়ায় বিশেষ করে তার চ্যানেলে সাবের সাহেবকে নিয়ে এবং দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ অবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন করেছেন।
আমাকে নিয়ে পত্রিকায়ও লেখালেখি হয়েছিল, ঘটনার পরদিন।
এতে মন্ত্রণালয় সোচ্চার হয়ে উঠে কিছুটা, সাবের সাহেবের চিকিৎসার খরচ দিতে চাইলে আমি বারণ করে দেই।অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করার আশ্বাস দেয়া হয় তাদের থেকে ।
আর আমি ইতিমধ্যে রিমি আপুর চিকিৎসার ব্যবস্থা সিঙ্গাপুরে করিয়েছি। সকল কাগজপত্র রেডি।
৩/৪ দিন বাদেই রহমান সাহেব মোটামুটি সুস্থ হলে রিমিকে  নিয়ে সিঙ্গাপুর পাড়ি দেব আমরা।
আর ১০ কোটির পুরোটাই আমি সাবের সাহেবকে দেইনি।উনাকে চিকিৎসার খরচের জন্য রাজি করাতেও বেশ বেগ পোহাতে হয়েছিল। অবশ্য উনাকে হয়ত অন্তত ১০/১৫ মিনিট দেরীতে গেলে চিরতরের জন্য হারিয়ে ফেলতাম।
এরপর উনাকে একটা প্রস্তাব দেই। তাতে উনি সানন্দে রাজি।
বাকী ৯ কোটি ২০ লাখ দিয়ে আমরা দেশের দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন ঘুচিয়ে দেয়ার জন্য খরচ করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। যেটা সরকার পারেনি, সে দুর্বোধ্য কাজে আমরা পা বাড়িয়েছি।
                                                 সমাপ্ত

লেখা ভালো লাগলে ফেসবুকে শেয়ার করবেন। :)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ