অভিজ্ঞতা | গোমতীর পাশের অচেনা শহরে একদিন

গোমতীর পাশের অচেনা শহরে একদিন

আজ আমি নিজের অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। এবং এটা আজকেই হয়েছে (১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫)।প্রথমেই কিছু অপ্রয়োজনীয় কিন্তু প্রয়োজনীয় কথা বলেছি।আর এই অভিজ্ঞতা একদিক থেকে থ্রিলিং ছিল।কারণ,আজকের পর থেকে হয়ত আমাকে আর পাওয়া যেত না।নাটকীয়তা ভাবে আমি ফিরে এসেছি।
জীববিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল আজ। আমি ২ মাস আগে ঠিক যেমন পড়িনি। একমাস আগে ঠিক যেমন পড়িনি।পরীক্ষার আগেরদিনও তেমনভাবে পড়িনি।পরীক্ষায় গিয়েছিলাম একেবারে শূন্যহাতে। যা হবার তাই হল,  প্রশ্ন পেলাম কিন্তু টপিক পরিচিত হলেও উত্তর দুর্বোধ্য ছিল।তাই পেছনজন "আলী ইমরানের " সহায়তা নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হলাম।
ভাবছিলাম নিজে নিজে।মন প্রচন্ড রকমের বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আমার এরকম চলতে থাকলে আমি কোন কিছুই করতে পারব না জীবনে। আগামী কয়েক বছর পর আমার ফ্রেন্ড সকলে সমাজে উচ্চস্থানে গিয়ে তারার মত জ্বলজ্বল করবে আর আমি এইভাবে চলতে থাকলে জীবনে কিছুই করতে পারব না।
কোন এক কারণে নিজের মধ্যের সকল আত্মবিশ্বাস, সৎসাহস, পরিশ্রম করার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা সব মরে ভুত হয়ে গেছে গত কয়েকমাসে। মন বিক্ষিপ্ত থাকে, উদাস থাকে। সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আট দশজনের মত সিগারেট না ধরে; ধরেছি বই(গল্প/উপন্যাস)। সারাদিন পড়ি আর পড়ি।যতক্ষণ পড়ি ততক্ষণ মোটামুটি মনটা ঠিক থাকে।এরপরই আবার আগের মত।যেন কূল পাচ্ছি না। কেউ একজনের জন্য খুবই কাতর আমি,খুবই ব্যাকুল।ব্যাপারটা সত্য।কিন্তু এসব সত্ত্বেও নিজেকে উঠাতেই পারছি না আমি। ভাবছিলাম এইসব হাবিজাবি। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল আমি জীবনের যে পথটা ধরে এগুচ্ছি সেটা হঠাৎ করে উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে। একটা উদ্দেশ্যহীন হাঁটার ইচ্ছে হল সেই বিকেলবেলা।
ইচ্ছেটা যখন হল তখন আমি হাঁটতে হাঁটতে ধর্মসাগর এর থার্ড গেইট দিয়ে বেরিয়েছি।এরপর হাঁটতেই থাকি।হাঁটি।
একসময় মনে হল যাই গোমতীর পাড়।দেখি ওখানে গিয়ে মন ভালো হয় কিনা।মোবাইল ব্যাগে পুরলাম-বাইব্রেশন এ রেখে।শুনলাম ওখানে নাকি হাইজ্যাক বা ঠেকবাজি বেশি হয়।তাই মোটামুটি সুরক্ষার ব্যাবস্থা।হাতে বা পকেটে থাকলে দেড় মাইল দূর থেকেও অপরাধীর চোখে পড়বেই। তো এমনটি করে হাঁটতে থাকি।দেখতে দেখতে রাস্তার মানুষ ও তাদের কাজ কর্ম।
আদালত পাড়া হয়ে গিয়েছিলাম ক্লাস এইটে থাকতে প্রথম এবং তখনই শেষবার ছিল।আজকের ট্রিপ সহ দ্বিতীয় হবে।
জজ কোর্ট এর সামনে পোঁছাতেই ক্ষীণ ইচ্ছা হল ভেতর থেকে ঘুরে আসি। গেলাম ও। গিয়ে আরেকটা গেইট দিয়ে বেরিয়ে জর্জকোর্টের ঠিক পাশের রাস্তায়। ওটা গিয়ে যে রাস্তায় পড়েছে (সড়কের নাম মনে নেই) ওটার ঠিক বাম বরাবর হাঁটতে থাকলেই একসময় গোমতীর দেখা মেলে।আমি আগের বার সাইকেলে গিয়েছিলাম এইবার পুরো হেঁটে। এইবার আরো হাল্কা পাতলা ঝুঁকি ছিল, সেটা হল, আমার কাছে একটা টাকাও ছিল না। আমি সব টাকা বাসায় রেখে বেড়িয়েছিলাম।মোটামুটি আসা যাওয়ার রিকসা ভাড়াটাও যা ছিল শেষ করে ফেলেছিলাম। তাই আমি যদি কোন রকম পথ হারানোর মত কাজ করি ফেরার জন্য টাকার অভাবে সমস্যায় পড়ব। গোমতীর তীরে গেছি, বহু বছর আগে।একা আবার যাচ্ছি, আন্দাজে।তাই পথ হারানো তেমন কিছু না আমার জন্য।
সাহস করে এগুতে থাকি। বিশ বা পঁচিশ মিনিট কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় হাঁটার পর দেখা পাই গোমতীর। নদীতে পানি নেই বললেই চলে।কোনমতে নিচে নামি।হাঁটতে থাকি পাড় ঘেঁষে। একসময় ভালো একটা জায়গা দেখে নেমে হাত পা ধুই।তখন মনটা আমার ফ্রেশ হয়ে যায়। বেশ লাগে।
এরপর আরো হাঁটতে হাঁটতে চাঁদপুর ব্রিজটার ওদিকে উঠি। ব্রিজটা পাড় করা মোটামুটি ঝুঁকির ছিল।দুটো যানবাহন পাশাপাশি চললে (অটো,সিএনজি), কিংবা একটা (বাস,ট্রাক) আর এক রত্তি জায়গা থাকে না চলার। আর ব্রিজটা কংক্রিটের নয়, লোহার ব্রিজ। ওটা পাড় হয়ে আমি উত্তর দিকে বাম দিকে বাবুইবাজার বরাবর হাঁটার সিদ্ধান্ত নেই। একেবারে আযান না পড়া পর্যন্ত। ততক্ষণে ক'টা বেজেতে মনে নেই তবে আমি ১০/১৫ মিনিট হাঁটার পরই মাগরিবের আযান দিয়ে দেয়।
ফিরতে থাকি। আবার ব্রিজটা পার হয়ে এদিকটাত চলে আসি। এবার এখান থেকেই আজব এক যাত্রা শুরু হয়। এদিকটায় বরাবর ফিরে যে পথটা দেখলাম। ওপথটা বরাবর একটা বাস চলে গেল।ওটার নাম "বীর প্রতীক" খেতাব প্রাপ্ত কোন মুক্তিযোদ্ধার নামে।নাম মনে নেই কিন্তু নিচে  লেখা বীর প্রতীক কথাটা মনে আছে।
আমি সেটা ধরে এগুতে থাকি।কারণ আপাত দৃষ্টিতে ঐ পথটা মনে হয় আগের পথটার সাথে যোগ সূত্র আছে।মানে ঐ কাপ্তান বাজার মাজার রোডটার সাথে। যে পথ ধরে আমি গোতমীর পাড়ে উঠেছিলাম।
সে পথ ধরে এগুতে থাকি।একটি অপরূপ বাড়ি দেখলাম,সে বাড়ির সামনে হয়েই পথটা চলে যায়। বাড়ি নাম বোধহয়, গরীবে নেওয়াজ হাউজ।উপরে অন্য নাম ছিল। বাড়িটার রঙ ছিল লাল।
আমি এগুতেই থাকি।কিন্তু রাস্তার শেষ সংযোগস্থল আর পাই না। ততক্ষণে আমার বিপরীত দিকে একটি বাস চলে গেল। মনে হচ্ছিল বাস স্ট্যান্ড তো চকবাজারে হবে হয়ত।এই পথে গেলেই হয়ত সামনে কোথাও চকবাজারের দেখা পাব।ওখানে গেলেই বাকিপথ আর সমস্যা হবে না। আমি চলতেই থাকি।তখন ফেরার ইচ্ছে হল না। আর সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তিনটের মত মসজিদ পার হলাম। এমন এক জায়গা পার হলাম, যেটার এখানে ওখানে বখাটেদের আড্ডা দেখলাম। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার রাস্তায় কোন বাতি নেই।রাত হয়ে আসছে দেখ ও রাস্তায় সমস্যায় পড়তে হবে। আমি আবার শেষ দিক পাব ভেবে হাঁটতে থাকি।তখন এক বাজারে এসে উপস্থিত হই, নাম দেখে আশ্চর্য আমি। নাম,  বউবাজার। আমি আরো হাঁটার জন্য পা বাড়াই।ততক্ষণে বুঝতে পারি পা আমার ব্যাথায় টনটন করছে।আমি তবুও কষ্ট করে হাঁটতে হচ্ছে।ভাবলাম কাউকে জিজ্ঞেস করব, ভাই কান্দিরপাড় কিভাবে যাওয়া যাবে?? কিন্তু হঠাৎ মনে হল সামনে একটা মোড়। হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে ওখানে গিয়ে দারুণ বিস্মিত হই। কারণ, ঐ মোড় আমার কাঙখিত মোড় টা না।মনে করতে থাকি আসার সময় কোন মোড় দেখেছিলাম কিনা??
উত্তর অবচেতন মনই দিল, না।
আমি আরেকটু সামনে এগিয়ে ফিরার জন্য পা বাড়াই।ফিরতে হলে এই বাড়তি হাঁটা টুকু আবার হেঁটে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে যেতে হবে।
পা তখন অনেক ব্যাথা।হাল্কা দাঁড়াই। হাঁটতে হাঁটতে দেখি আমি পথ ভুলে গেছি।আন্দাজ করতে করতে এগুচ্ছি। বার বার নিজেকে বোঝাচ্ছি, ফিরতে পারব।কুমিল্লা আমার নিজেরই জায়গা এখানে আমি হারিয়ে যাব না।
চারদিক অন্ধকার তখন।কোন দিকে ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে কোনদিকে জ্বলে না।তাই পথ হারানোর আরো ভয়।
মনে মনে দোয়া করি কোন ফ্রেন্ড যদি এখানে পাওয়া যেত। যে সাহায্য করতে পারত। আমি যে বাড়তি ২/৩ কি.মি হেঁটে পথ ভুলে গেছি সেখান থেকে ফেরার রাস্তা দেখাবে।
তখন আল্লাহ্‌ এর কুদরত কিনা জানি না।এই লোকটার আগমন ঘটল।
মোঃ জুয়েল।
পেশাঃ রিক্সা চালানো।(নিজের রিক্সা)
আমার পাশ ঘেঁষে রিকসা চালিয়ে যেতে যেতে বলল, কোথায় যাবেন বাজারে??(বউবাজার,আমি তখন এবাজার থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি)
আমি বললাম, এই তো সামনেই।আমার রিক্সা লাগবে না।চলে যেতে পারব। (টাকা নেই,একথা বলতে পারিনি)
তখন আমাকে অবাক করে বলে, টাকা লাগবে না।
আমি বললাম লাগবে না।ইতস্তত করতে লাগলাম।এই সন্ধ্যায় উনি আবার কইই নিয়া যায়??
আমি সামান্য সামনে এগিয়ে গেলাম।তিনি আবারও আসলেন।এগিয়ে একই কথা বললেন।এবং সাথে যোগ করলেন তার নিজের রিক্সা একটু পর রিক্সা লক করে বাসায় চলে যাবেন। তাই আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন।আর উনি বাজারের দিকেই যাচ্ছেন।
আমার শুধু বাজারের দিকেই গেলে হবে না,আমাকে যেতে হবে একেবারে ব্রীজের ওদিকে, ওদিকে গেলেই তবে বাড়ি ফিরতে পারব।নতুবা পথ হারিয়ে যে ফেলছি।
আমি উনাকে সাফ সাফ বলে দিয়েছিলাম, ভাই টাকা তো একটা পয়সাও নাই। ভাড়া তো দিতে পারবনা।শিওর ফ্রিতে নিবেন??
উনিও বললেন হ্যাঁ নিবেন।আমি উঠে পড়লাম।তখন বললাম আপনি কতটুক যাচ্ছেন? উনি বললেন ব্রিজের ওদিকেই উনার বাড়ি। ব্রিজের আশেপাশেইই(কোন দোকানে) রিকসা রেখে বাসায় যাবেন। আমি তখন বলি ভাই আমাকেও ওদিকে নিয়ে যান।
তখন উনি বললেন, ওখানে গেলে ১০ টাকাও দিবেন না? আমি উনাকে বললাম, ভাই ঘুরতে এসে বিপদে পড়লাম।টাকা পয়সা সব শেষ।
উনি আর না ভেবে রিকসা চালাতে শুরু করলেন।আমি নিজের ভাগ্য এবং জীবন তখন আরেকবারের মত সংকটে ফেলি।চেনা নেই,জানা নেই এমন একজনের মাগনা ট্রিপ এর প্রস্তাবে রাজি হই।
রিকসায় এগুতে লাগল।উনি ও নিজের কথা বলে চলেছেন কিন্তু রাস্তায় রিকসার শব্দে কিছুই বুঝতে পারিনি।একসময় উনার নাম জিজ্ঞেস করি।নাম বলেন।চলতে চলতে একসময় বউবাজার পার হই। একসময় সেই লাল অপরূপ বাড়িটার সামনেও চলে যাই।
এবং ভাঙ্গা রাস্তায় লোকটা নির্দ্বিধায় আমাকে টেনে নিয়ে যায়।একেবারে ওখানে যেখান থেকে অজানা এই পথের রাস্তা শুরু। উনি নামিয়ে দেননি। আমাকে পুরো উঁচু জায়গাটা টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। আমি নেমে গেলাম।উনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে আসি এবং নিশ্চিত হই, অন্য কোন সময় গেলে তাকে ওখানেই পাব।বাকী কাহিনী আরর কি? কোন বিশেষতা নেই।যেভাবে যেপথে এসেছিলাম গোমতীর পাড়। অন্ধকার ঠেলে, মাজার রোজ, আদালত রোড হয়ে আবার ধর্মসাগরে পৌঁছে সেখানে কিছুক্ষণ বসে এরপর বাসায়।বাসায় ফিরে দেখি তখন চোখে পড়ে ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা ৭ টায় মাত্র পৌঁছেছে।
সত্যি কথা বলতে কি, আজ আমি কোনমতেই ফিরতে পারতাম না যদি লোকটা সেধে আমায় হেল্প না করত,এবং তাও বিনাপয়সায়,বিনা স্বার্থে।।সারারাত ক্ষিদেয়, ঠান্ডায় এক অপরিচিত জায়গায় ঘুরতে হত বার বার।লোকজন অন্যভাবে দেখত।এবং খুব সম্ভবত কোন নিশিঘাতকের হাতে পড়ে যেতাম।
এই অভিজ্ঞতায় রঙ,নাটকীয়তা সব ঐ আশ্চর্য সেই ভালোমানুষটি। যে আমায় একটা আসন্ন বিপদ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। সবই আল্লাহর কৃপা। নাহয়, এভাবে এই নাটকীয়তা হত না।
হয়ত আমি ফিরতে পারতাম।কিন্তু চান্স ছিল কম।লোকটার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।  :)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ